আইনকে ফাঁকি দেওয়ার ঝুঁকি নেই। নেই সাজার ভয়ও। খালি দোকানে যাওয়া আর কিনে আনা। তার পর শুধুই ‘আমোদ’। আইনে নয়া সংশোধনী আনার পর কলোরাডো জুড়ে মাারিয়ুয়ানা এখন এতটাই সহজলভ্য। বুধবার মানে নতুন বছরের প্রথম দিনে বিনোদন-মাদক হিসেবে মারিয়ুয়ানার বিক্রি শুরু হল কলোরাডোতে। আর শুরুর দিনেই কিস্তিমাত।
কনকনে ঠান্ডা ও তুষারপাত অগ্রাহ্য করে মঙ্গলবার গভীর রাত থেকেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন উৎসাহী ক্রেতারা। তাঁদের প্রত্যেকের মুখে একই কথা “ঐতিহাসিক মুহূর্তটির সাক্ষী থাকব বলেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।” কীসের ঐতিহাসিক মুহূর্ত? এল ঝটিতি জবাব। “এর জন্য আমরা ভোট দিয়েছি। আর আজ এটাই হতে চলেছে।” বাস্তবিক। বিনোদন-ফুর্তি-আমোদের জন্য মারিয়ুয়ানা চাষবাস এবং বেচাকেনা যাতে আইনি বৈধতা পায়, সে জন্য আন্দোলন করেছেন কলোরাডোর বহু বাসিন্দা। গত বছর এ নিয়ে ভোটাভুটিও হয়। আর তাতেই জানা যায়, কলোরাডোর বেশির ভাগ মানুষ বিনোদন-মাদক হিসেবে মারিয়ুয়ানা ব্যবহারের পক্ষে। তার পরেই পাশ হয় ৬৪তম সংশোধনী। বুধবার ছিল বিনোদন-মাদক হিসেবে মারিয়ুয়ানা বিক্রির প্রথম দিন। সেই উপলক্ষে ক্রেতারা ছাড়াও ভিড় জমিয়েছিল সংবাদমাধ্যম। |
আর সেখানেই দেখা মিলল শন আজ্জারিতির। বুধবারের বিকিকিনির প্রথম খরিদ্দার। সংবাদমাধ্যমের সামনে এক ব্যাগ মারিয়ুয়ানা কিনলেন শন। তবে দু’ভাগে। কিছুটা কাঁচের সুদৃশ্য বোতলের মধ্যে, বাকিটা চকোলেট ট্রাফল পেস্ট্রির ভিতরে পুরে। ক্রেতাদের পছন্দের কথা মাথায় রেখে পেস্ট্রি বা নানা রকমের খাবারের ভিতরে পুরেও বিক্রি হচ্ছে এই মাদক। তবে পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত। কারণ, ৬৪তম সংশোধনীর পরও মারিয়ুয়ানা ব্যবহারের উপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেমন ২১ বছরের কম বয়সের বাসিন্দারা বিনোদনের জন্য এই মাদক কিনতে পারবেন না। এক বারে সর্বাধিক এক আউন্স বা ২৮ গ্রামের বেশি মারিয়ুয়ানা কিনতে পারবেন না কেউ। কলোরাডো ছাড়া অন্য কোনও দেশের বাসিন্দা হলে এক-তৃতীয়াংশ আউন্সের বেশি কেনার অনুমতি নেই। বিমানবন্দরে মারিয়ুয়ানা নিয়ে যাওয়া চলবে না। এবং জনসমক্ষে এর বিনোদনমূলক ব্যবহার এখনও নিষিদ্ধ।
এত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কলোরাডোর বাসিন্দারা কিন্তু মহা আনন্দে। তাঁদের একটাই বক্তব্য, এখন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া মারিয়ুুয়ানা কিনতে গেলেও হাতে হাতকড়া পড়বে না। জেলেও যেতে হবে না। সোজা ভাষায় বিনোদনের জন্য এই মাদক এখন কোনও রকম আইনি জটিলতা ছাড়াই কিনতে পারবেন তাঁরা। গোটা আমেরিকায় কলোরাডোই প্রথম রাজ্য যেখানে বিনোদন-মাদক হিসেবে মারিয়ুয়ানা ব্যবহারের ছাড়পত্র মিলল। তার পরেই রয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি। সেখানেও মারিয়ুয়ানার বিনোদনমূলক ব্যবহারের পক্ষে রায় দিয়েছে জনতা। নতুন বছরের শেষের দিকে সে রাজ্যেও এই মাদকের বিক্রি শুরু হওয়ার কথা।
আমেরিকার ফেডারেল আইন অবশ্য এখনও এই মাদকের বিনোদনমূলক ব্যবহারের বিপক্ষে। তবে রাজ্যগুলিকে এ ব্যাপারে নিজস্ব আইন প্রণয়নের ছাড় দিয়েছে ওবামা-প্রশাসন। কিন্তু কলোরাডোর পরিস্থিতির দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। মারিয়ুয়ানার বিনোদনমূলক ব্যবহার যাতে কোনও ভাবেই সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, সে দিকে লক্ষ রাখছে প্রশাসন। সে রকম কিছু হলে ওবামা-সরকার হস্তক্ষেপ করবে, এমন কথাও বলা হয়েছে। তবে বুধবারের পর কলোরাডো-প্রশাসন অবশ্য অনেকটাই নিশ্চিন্ত। সকাল আট’টায় বিকিকিনি শুরু হওয়ার আগে থেকেই ক্রেতাদের বয়স নিয়ে নিশ্চিত হতে পরিচয়পত্র দেখতে চেয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। আইন মেনে বিকিকিনি চলছে কি না, তা দেখতেও দোকানের ভিতর নজরদারি চালানো হয়েছে। এ পর্যন্ত গোটা কলোরাডোয় ১৩৬ জন খুচরো বিক্রেতাকে মারিয়ুয়ানা বিক্রির অনুমতি দিয়েছে সরকার। তাঁরা ছাড়া যেন অন্য কেউ এই মাদক বিক্রি
করতে না পারেন, সে দিকেও লক্ষ রাখা হয়েছে।
কিন্তু নিয়ন্ত্রণ-নজরদারি সত্ত্বেও উদ্বেগ কমছে না কলোরাডোর বাসিন্দাদের একাংশের। তাঁদের আশঙ্কা, বিনোদনমূলক ব্যবহার থেকে যে কোনও মুহূর্তে মারণ নেশায় পরিণত হতে পারে এই মাদক সেবন। বিশেষত মার্কিন মুলুকে এ হেন নেশা নতুন কিছু নয়। আম জনতা তো বটেই, পল ম্যাকার্টনি, ব্র্যাড পিট, নাতালি পোর্টম্যানের মতো তারকা গায়ক-অভিনেতারাও এই নেশার কবলে পড়েছিলেন। ফলে নিছক ফুর্তি-আমোদের মারিয়ুয়ানা যে মারণ নেশায় পরিণত হবে না, তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়? তা ছাড়া, দীর্ঘমেয়াদি মারিয়ুয়ানা সেবন শরীর এবং মনের পক্ষে যে ভীষণ ক্ষতিকর, তা-ও অজানা নয়। সব মিলিয়ে মারিয়ুয়ানার দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার যদি প্রাণঘাতী হয়, সেটা ভেবেই আতঙ্কিত বাসিন্দাদের একাংশ। বস্তুত এ সব কারণেই মার্কিন মুলুকের ২০টি রাজ্যে শুধুমাত্র চিকিৎসার উপাদান হিসেবে মারিয়ুয়ানার ব্যবহার চালু ছিল এত দিন। তা-ও সীমিত ভাবে।
সে প্রথাই ভাঙল কলোরাডো। আর তাতে যারপরনাই খুশি শন। মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন এই সদস্য আপাতত ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে’ ভোগেন। উদ্বেগ, আশঙ্কায় ঘুম আসে না। কিন্তু এত দিন এ রোগের চিকিৎসার জন্য মারিয়ুয়ানার ব্যবহার আইন-স্বীকৃত ছিল না। বুধবারের পর অবশ্য কোনও বাধা রইল না। এ বার উদ্বেগ, আশঙ্কা তাড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন বলে আনন্দে তিনি বলে ওঠেন, “এর জন্যই তো গত ক’বছর ধরে লড়েছি।”
আপাত ভাবে সে লড়াই বুধবার শেষ হল। কিন্তু একই সঙ্গে শুরু হল নতুন লড়াই। বিনোদনের মারিয়ুয়ানাকে কোনও মতেই মারণ নেশার উপকরণে পরিণত না হতে দেওয়ার লড়াই, নিয়ন্ত্রণের লড়াই, আত্মসংযমের লড়াই। |