নতুন বছর আসার আগে পুরনো বাড়িটা মেরামতির ইচ্ছা ছিল আসানসোলের গীতা নস্করের।
দীনেশ সাউ পরিকল্পনা করেছিলেন, বোনের বিয়েটা বেশ ধুমধাম করেই দেবেন।
নববর্ষে গ্যারাজটা সারাবেন ভেবে রেখেছিলেন বর্ধমানের ছোট নীলপুরের শেখ হাসান আলি।
নতুন বছর এসে গেলেও তাঁদের কারও ইচ্ছাই পূরণ হয়নি। কারণ, মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও লগ্নি সংস্থায় রাখা আমানত ফেরতই পাননি তাঁরা। যে সংস্থায় টাকা রেখেছিলেন, সেই বর্ধমান সনমার্গের অধিকাংশ অফিসেই তালা ঝুলছে জেলায়। অনেক কর্তা ফেরার। গ্রেফতার হয়েছেন কয়েকজন কর্মী-আধিকারিক। এই পরিস্থিতিতে আমানত আর আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কি না, জানা নেই গীতাদেবীদের।
বর্ধমান জেলা জুড়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই আমানত সংগ্রহের কাজ করছিল সংস্থাটি। ২০০৯ সালের এপ্রিলে দুই গ্রাহক খোদ জেলাশাসকের কাছে চিঠি লিখে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত দাবি করেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, সংস্থাটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি না নিয়েই কোটি-কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করছে। তৎকালীন জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা জেলা এনফোর্স বিভাগকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
তার পরেও দফায়-দফায় এই সংস্থার বিরুদ্ধে আমানতের টাকা না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সূত্রে খবর, গত কয়েক বছরে জেলা থেকে বিপুল টাকা আমানত সংগ্রহ করে সংস্থাটি। শেষে বর্ধমান থানার পুলিশ গত বছরের মাঝামাঝি এক আমানতকারীর টাকা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে সংস্থার বর্ধমানের মূল শাখাটি বন্ধ করে দেয়। কয়েক জন কর্মীকে গ্রেফতার করা হলেও, সংস্থার কর্ণধার সৌম্যরূপ ভৌমিক-সহ বেশ কয়েক জন পদস্থ কর্তা এখনও পলাতক, জানিয়েছে পুলিশ। শিল্পাঞ্চল থেকেও বিপুল টাকা আমানত সংগ্রহ করেছিল এই লগ্নি সংস্থা। জানা গিয়েছে, প্রায় ১০৪৩ জন এজেন্ট এই সংস্থায় কাজ করতেন। সম্প্রতি নিয়ামতপুরে ওই লগ্নি সংস্থার দফতরের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভ করেন আমানতকারীরা। পুলিশ সংস্থার এক আধিকারিককে গ্রেফতারও করে।
জেলার বহু লগ্নিকারীরই আমানতের মেয়াদ ফুরিয়েছে সেপ্টেম্বরে। সেই অনুযায়ী তাঁরা টাকা ফেরতের আশা রেখে নানা পরিকল্পনা করেছিলেন। আসানসোলের গীতাদেবী যেমন বলেন, “ভেবেছিলাম, নতুন বছরের আগে ভেঙেচুরে যাওয়া ঘরটা একটু সারিয়ে নেব। টাকাটাই তো পেলাম না।” আর এক আমানতকারী দীনেশ সাউ বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম, মাঘ মাসে বিয়ের অনুষ্ঠান করব। সেপ্টেম্বরে যে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, এখনও পাইনি। অফিসে তালা ঝুলিয়ে ওরা পালিয়ে গিয়েছে।” মুন্নি রজক নিজের সামান্য রোজগারের কিছু অংশ জমিয়েছিলেন নতুন বছরের আগে ঘরের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করার জন্য। তিনি বলেন, “তা আর হল না। কবে টাকা পাব, জানি না!”
শিল্পাঞ্চলের এই আমানতকারীরা জানান, সারদা-কাণ্ডের পরে তাঁদের সংস্থার কাছেও টাকা ফেরতের দাবি জানাচ্ছিলেন তাঁরা। আমানতকারীদের অভিযোগ, সেই সময় তাঁদের জানানো হয় সেপ্টেম্বরে মেয়াদ ফুরোনর পরে টাকা সুদ-সহ ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকেই দফতরের আধিকারিকেরা টালবাহানা শুরু করেন বলে অভিযোগ। বারবার বিক্ষোভও দেখান আমানতকারীরা। কিন্তু মাসখানেক আগে তাঁরা দেখেন, অফিসে তালা ঝুলছে। এর পরেই কয়েক জন কুলটি থানায় অভিযোগ জানান।
একই দশা জেলার গ্রামীণ এলাকার আমানতকারীদেরও। বর্ধমানের ছোটনীলপুরের গ্যারাজ ব্যবসায়ী শেখ হাসান আলির কথায়, “আমি মাসে-মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা করে ওই সংস্থায় রেখেছিলাম। মাস চারেক আগে আমার প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার টাকা ফেরত পাওয়ার কথা ছিল। সেটা গ্যারাজের ব্যবসায় ঢালতাম। কিন্তু সংস্থার অফিসই তো বন্ধ। টাকা ফেরতের তাই আর কোনও আশা দেখি না।” গলসির শেখ নুরউদ্দিন হোসেন আবার বলেন, “খুব কষ্ট করে ২২ হাজার টাকা রেখেছিলাম বর্ধমান সনমার্গে। ফেরত পাওয়ার কথা ছিল প্রায় ৪০ হাজার টাকা। মেয়ের বিয়েতে কাজে লাগত। এখন মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।”
জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তার দাবি, “সৌম্যরূপবাবুদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে থেকে নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমানত সংগ্রহ বা শেয়ার বিক্রির মতো কাজ ওই সংস্থার করার অনুমতিই ছিল না। তবে মূল অভিযুক্তেরা পলাতক বলে পুলিশ মামলার চার্জশিট দিতে পারছে না।”
পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “সারদা-কাণ্ডের পরে বর্ধমানের এই সংস্থাটি নিয়ে অভিযোগ আসা মাত্র পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে সারদার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে জেলায়। তার চার্জশিট দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই মামলাগুলির চাপেই বর্ধমান সানমার্গের বিরুদ্ধে আমাদের তদন্ত ঠিক মতো গতি পায়নি।” |