দমবন্ধ ইতিহাস, জ্বলন্ত বাংলাদেশ
‘গুন্ডে’র টিজার।
পর্দায় ভেসে ওঠে একটা তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
দরাজ গলায় বলে চলেন ইরফান:
‘লকিরে বহুত আজব হোতি হ্যয়
খাল পে খিঁচি যায়ে তো খুন নিকল দেতি হ্যয়
অউর জমিন পে খিঁচি যায়ে তো সরহাদে বনা দেতি হ্যয়।
যব বাংলাদেশ বনা তো উহা হিন্দুস্তানি মুলক কে হাজারো লোগ থে
জিনকে পাস না খানে কো রোটি থি না সর ঢাকনে কো ছত।
অ্যাইসি হি ভিড় মে পড়ে হুয়ে দো অনাথ দোস্ত বিক্রম অউর বালা...’

কাট।
টিজারে বলা এই কথাগুলো নিয়েই আপত্তি মৃতুঞ্জয় দেওরাথ-য়ের।
‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’য়ের পরিচালক।
যে হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ফারুখ শেখ, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইমা সেন, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, তিলোত্তমা সোম আর ঋদ্ধি সেন। ‘গুন্ডে’র মতো সে ছবির পটভূমিও ১৯৭১। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ।
যে ছবির মুক্তির জন্য অধীর আগ্রহে ছিলেন ফারুখ শেখ। ক্রিসমাসের দিনও যার সম্পর্কে পরিচালককে বলেছিলেন যে এমন একটা ছবি বানানো যতটা কঠিন, তার থেকে বেশি কঠিন আমাদের দেশে মুক্তি পাওয়া।
তবে ‘গুন্ডে’র টিজার নিয়ে পরিচালকের আপত্তি কোথায়?
“কারণ ইরফান যে কথাগুলো বলছেন, তা ফ্যাকচুয়ালি ঠিক নয়। ১৯৪৭-য়ের পরে তো পূর্ব-পাকিস্তান বলা হত। তা হলে কী করে ইরফান এমন একটা কথা বলছেন যে, ‘যব বাংলাদেশ বনা তো হিন্দুস্তানি মুলক কে হাজারো লোগ থে’। বলতে পারতেন, ‘হিন্দু মুলক কে হাজারো লোগ থে’। কিন্তু হিন্দুস্তানি তো বলা যায় না। এটা তো তথ্যগত ভাবে ভুল। আমরা কত রিসার্চ করে সিনেমা বানাই। পাকিস্তানের ২৪ বছর স্রেফ মুছে গিয়েছে টিজারে। এতটা অজ্ঞতা কেন? ১৯৭১-এ এই রকম একটা গণহত্যা হয়েছিল বাংলাদেশে আর তা নিয়ে সে রকম কোনও কাজই হল না! শুধু অফিশিয়াল পরিসংখ্যানে বলা হল, ‘চার লাখ মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। তিরিশ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে। এক কোটি লোক ভারতে রিফিউজি হয়ে গিয়েছে’,” এক নিশ্বাসে বলে চলেন মৃত্যুঞ্জয়।
‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’য়ে রাইমা।
এই ঘটনা নিয়ে রিসার্চ করেই বানানো হয় সিনেমা ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনটে পৃথক গল্প নিয়ে তৈরি হয়ে হয়েছিল চিত্রনাট্য। তবে সিনেমা তো ইতিহাসের ক্লাস নয়। তাই ছবিটা যাতে শুধুমাত্র সময়ের দলিল না হয়ে ওঠে তাও খেয়াল রাখা হয়েছে। মর্মস্পর্র্শী এক ছবি বানানোর সময়ও ঝক্কির শেষ ছিল না মৃত্যুঞ্জয়দের। প্রথমে কলকাতাতে শ্যুটিং করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু কলাকুশলীদের সঙ্গে সমস্যা হওয়াতে রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়ে দিল্লিতে শ্যুটিং করেন।
সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে পাঙ্গা চলছে এখনও। ‘বাস্টার্ড’ শব্দটা নিয়ে আপত্তি উঠেছে। “অথচ কিছু দিন আগেই, ‘দ্য ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’ বলে একটা সিনেমা দেখাতে আমাদের দেশের সেন্সরের কোনও আপত্তি হয়নি,” বললেন পরিচালক।
একই দেশে দু’ রকম নিয়ম কেন? ব্র্যাড পিট বা কোয়ান্টেন ট্যারেনটিনোর জোর? “না, না। আমাদের দেশে সাদা চামড়া দেখলে নিয়ম অন্য রকম হয়ে যায়,” স্পষ্ট বলেন তিনি।
বাংলাদেশে ছবিটা মুক্তি পাওয়ার জন্য ওখানকার সেন্সর বোর্ড কিছুটা বদল করতে বলেছে। “হিংসার দৃশ্য কমাতে বলা হয়েছে। তবে আমি বলেছি যে ঘটনাটা গণধর্ষণের। আমি বোঝাই যে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে একটা দুটো ধর্ষণ তো দেখাতেই হবে ছবিতে,” বলছেন পরিচালক।
আর সেটাও উনি খুব যত্ন নিয়েই দেখিয়েছেন। রাইমা সেন আর পবন মলহোত্র-র একটা ধর্ষণ দৃশ্য। যার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় ট্রেলরেও। “প্রথমেই এই ধর্ষণের দৃশ্য নিয়ে রাইমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ‘সাইকো’তে শাওয়ার সিনটার কথা আজও লোকে বলে। খুন দেখাতে গেলে কি আর সত্যিকারের ছুরিটা কী ভাবে শরীরে ঢোকানো হল সেটা দেখাতে হয় নাকি? এই ধর্ষণের কষ্টটা যাতে দর্শক অনুভব করেন সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি। রাইমাকে বলেছিলাম, আমি এখানে যৌনতা দেখানোর জন্য দৃশ্য রাখছি না। পবন স্যর আর ও মিলে কী পাওয়ারফুল অভিনয় করেছে,” জানাচ্ছেন মৃতুঞ্জয়।
আরও জানাচ্ছেন, “টলিউডে ইন্দ্রনীলকে ভালই সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বলিউডে এখনও তা দেখিনি। এই ছবিতে ওর অভিনয় সাড়া ফেলে দেবে। ঋদ্ধি একটা জঙ্গলের দৃশ্যে কত বার খালি পায়ে ছুটে ছুটে শ্যুটিং করেছে। আমার সব অভিনেতাই ছবির আদর্শটার প্রতি সমর্পিত।”
রাইমা বলছেন এই ফিল্মটা শ্যুটিং করার অভিজ্ঞতাটা তাঁর কাছে অভিনব। সিনেমাতে তাঁর স্বামী ইন্দ্রনীল পেশায় সাংবাদিক। পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময় রাইমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। “দম বন্ধ হয়ে আসত ওই রেপ ক্যাম্পের দৃশ্য শ্যুট করতে। একটা ‘ট্রাক সিন’ আছে। আমাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে উঠিয়ে দেওয়া হয় ট্রাকে। যখন পবন ট্রাকটা খুলত আমরা পড়ে যেতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জল ঢেলে দেওয়া হত গায়ে। অনেক মেয়েই তো অজ্ঞান হয়ে যেত। একুশ দিন টানা শ্যুটিং করেছিলাম এই ফিল্মের জন্য। রোজ রাতে শ্যুট। এই রকম ভাবে শু্যটিং আগে কখনও করিনি। একুশ দিন বাদে আমি এত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে কিছু দিন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলাম,” বলছেন রাইমা।
আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই এই ছবিটা হয়তো বাংলাদেশে মুক্তি পাবে। নাম দেওয়া হবে ‘চিলড্রেন অব ওয়ার।’ “ও দেশে ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ নামটা দেওয়াতে সমস্যা আছে। তবে এখনকার অস্থির, অশান্ত বাংলাদেশে এই ছবি মুক্তি পাওয়াটা যথেষ্ট তাত্‌পর্যপূর্ণ। লোকের জানা দরকার ১৯৭১-এর ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষকে সমর্থন করা দরকার,” বলছেন পরিচালক।
তবে বাংলাদেশে মুক্তির জন্য ছবিটা বাংলা ভাষায় ডাব করা হয়েছে। মূল কাস্ট থেকে ঋদ্ধি আর তিলোত্তমা নিজেদের গলা নিজেরাই বাংলায় ডাব করেছেন। সেই বাংলা ডাব করা সংস্করণ অবশ্য ভারতে মুক্তি পাবে না।
কেন এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত? এ রাজ্যে তো ‘গুন্ডে’ও বাংলা ভাষাতেই মুক্তি পাবে শোনা যাচ্ছে। পরিচালক বলছেন, “আমাকে তো বলা হয়েছিল, বাংলা ডাবড ভার্সান পশ্চিমবঙ্গে রিলিজ করায় কিছু অসুবিধে আছে। আমরা তো যশরাজ নই। টাকাপয়সার জোরটাও কম। একেবারে ইন্টিরিয়রে গিয়ে আমরা সিনেমাটা রিলিজ করাতেও পারব না। তাই হিন্দিতেই এই ছবিটা এ দেশে রিলিজ করব।”
আর যদি এ দেশে সেন্সর বোর্ড খুব ঝামেলা করে তা হলে সিনেমার নামও পাল্টে দেবেন। পরিচালক মুখে কুলুপ এঁটেছেন ‘বাস্টার্ড’ শব্দটা কার প্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা জানাতে। তবে ঠিক করে রেখেছেন যে খুব ঝামেলা হলে ভারতেও সিনেমাটার নাম রাখা হবে ‘চিলড্রেন অব ওয়ার।’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.