রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বড় একটি পর্ব মিটতে চলেছে কাল। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক অশোকবাবুর বিরুদ্ধে এক ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থা করা ও পেশাগত অসদাচরণের বেশ ক’টি অভিযোগ ওঠায় রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের বিরোধী দলগুলি পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁর অপসারণ চায়।
কেন্দ্রের মন্ত্রীরাও বলে আসছেন, অশোকবাবু ইস্তফা দিলেই ভাল হত। কিন্তু তিনি তা না করায় একমাত্র রাষ্ট্রপতিই তাঁকে অপসারণ করতে পারেন। কিন্তু তাঁর আগে মন্ত্রিসভার মত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করাতে হবে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। তিনি যাতে সুপ্রিম কোর্টকে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের সুপারিশ করতে পারেন সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রস্তাবে কাল অনুমোদন দিতে পারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা।
কেন্দ্রের এক মন্ত্রী জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার পর সম্ভবত কালই তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ফলে অশোকবাবুর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এখন সময়ের অপেক্ষা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ইতিমধ্যেই অশোকবাবুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত করেছে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টকে তদন্তের নির্দেশ দিলে সর্বোচ্চ আদালত ফের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখে তাঁকে রিপোর্ট দেবে। তার পরেই রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অশোকবাবুকে সরানো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন রাষ্ট্রপতি।
প্রশ্ন হল, মনমোহন সরকার কেন অশোকবাবুর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠাতে চলেছে?
মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য তৈরি করা নোটে তার কারণ ও যৌক্তিকতা সুনির্দিষ্ট ভাবে তুলে ধরেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ওই ক্যাবিনেট নোটে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে অশোকবাবুর অপসারণ চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’টি চিঠি লিখেছেন রাষ্ট্রপতিকে। তাতে অশোকবাবুর বিরুদ্ধে মূলত তিন দফা অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
• প্রথমটি অবশ্যই, এক ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থা করার অভিযোগ।
• দ্বিতীয় অভিযোগটি হল, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মতো পূর্ণ সময়ের পদে থেকেও ভিন্ন পথে রোজগার করা। অন্তত দু’টি ক্ষেত্রে এমনটা করেছেন বলে রাজ্য সরকারের দাবি। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের হয়ে একটি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তিনি পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল আগেই। কিন্তু এটাই শেষ নয়। সাত দিন আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে দ্বিতীয় চিঠিতে রাজ্য সরকার জানিয়েছে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সাগরদিঘি বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে চিনা বিদ্যুৎ সংস্থা ডংফাং-এর সঙ্গে সালিশি মামলায় রাজ্য বিদ্যুৎ নিগমের হয়ে আরবিট্রেটর হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে কাজ করেছেন। বিদ্যুৎ নিগমের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর দুর্গাদাস গোস্বামী রাজ্যের মুখ্য সচিব সঞ্জয় মিত্রকে গত ২৩ ডিসেম্বর এক চিঠিতে (নম্বর: পি ডি সি-সি এম ডি-০১৩-২৪৩) বিষয়টি সবিস্তার জানিয়েছেন। তাতে এ-ও বলা হয়েছে, নিগম আইনজীবীদের পারিশ্রমিক বাবদ প্রায় ৪,৯৭,৫০০ মার্কিন ডলার খরচ করেছে এ পর্যন্ত।
• অশোকবাবুর বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগটি হল, তিনি রাজ্যপালের অনুমতি ছাড়াই গত জুন মাসে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার এক আইনজীবীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন আইন লঙ্ঘন করেছেন।
রাজ্য সরকারের আনা এই সব অভিযোগ উল্লেখ করার পাশাপশি ক্যাবিনেট নোটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এও জানিয়েছে যে, পাকিস্তান সফরের জন্য অশোকবাবু যে রাজ্যপালের অনুমতি নেননি, তা রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিবকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। পাক সফরের জন্য তিনি যে বেসরকারি সংস্থার থেকে বিমান-টিকিট নিয়েছিলেন তা-ও কেন্দ্রকে জানিয়েছে রাজ্য সরকার।
অশোকবাবুর বিরুদ্ধে এই সব অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকের মত চেয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। আইন মন্ত্রকের কর্তারা ও পরে অ্যাটর্নি জেনারেল গুলাম বাহনবতীও দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেন, অশোকবাবুর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতি যাতে সুপ্রিম কোর্টে সুপারিশ করতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক মন্ত্রিসভা। প্রাথমিক তদন্ত করার সময় সর্বোচ্চ আদালত তাঁর বক্তব্য শোনেনি বলে অশোকবাবু সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছেন। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টকে তদন্তের নির্দেশ দিলে, তখন নিশ্চয়ই অশোকবাবুর বক্তব্যও শোনা হবে।
সংশয় নেই গোটা ঘটনাটি নিয়ে যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি হয়েছে রাজনীতিতেও। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে অশোকবাবুর অপসারণ চেয়ে সংসদে প্রবল দাবি তুলেছিলেন বিরোধীরা। একাধিক শীর্ষ মন্ত্রীও বিবৃতি দিয়ে বলেন, অশোকবাবুর উচিত নৈতিক দায় স্বীকার করে পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের এক মন্ত্রী আজও বলেন, কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন রাষ্ট্রপতির কাছে দু’-দু’বার চিঠি লিখে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন, তখন তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা কেন্দ্রের সাংবিধানিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অশোকবাবু নৈতিক দায় নিয়ে সরে দাঁড়ালে সরকারকে এই পথে হাঁটতে হত না। |