পরিকল্পনায় আটকে কর্ণগড় সাজার কাজ
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
রয়েছে বলতে শুধু মহামায়ার মন্দির। সংরক্ষণের অভাবে বাকি সব হারিয়ে গিয়েছে। বহু খুঁজেও দু-চারটে ইটের বেশি কিছু মিলবে না। চুয়াড় বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত রানি শিরোমণির গড়ের এখন এমনই দশা। গড় অর্থাৎ দুর্গের আর অস্তিত্ব নেই। অথচ, ঐতিহাসিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ কর্ণগড়কে পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনার দাবি দীর্ঘ দিনের। বিভিন্ন সময়ে নেতা-নেত্রী থেকে মন্ত্রী-সাংসদ এলাকায় এসে নানা উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন। মেদিনীপুর শহরে রানি শিরোমণির নামে গেস্ট হাউস হয়েছে। শিরোমণির নামে ট্রেনও চলে। কিন্তু কর্ণগড় থেকে গিয়েছে অন্ধকারেই।
কর্ণগড়ের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইন্দ্রকেতু নামে এক রাজা এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ইন্দ্রকেতুর ছেলে নরেন্দ্রকেতু মনোহরগড় স্থাপন করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। রণবীর সিংহ নামে এক লোধা সর্দারকে রাজ্য শাসনের ভার দেন তিনি। অপুত্রক রণবীর সিংহ অভয়া নামে এক মাঝির ছেলেকে পোষ্যপুত্র করে তাঁর হাতে রাজ্য শাসনের ভার অর্পণ করেন। তারপর বংশপরম্পরায় রাজ্য শাসন চলতে থাকে। |
আগাছায় ঘেরা ধ্বংসস্তূপ। |
১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় শেষ অপুত্রক রাজা অজিত সিংহের। তাঁর দুই রানি ছিলেনভবানী ও শিরোমণি। রানি শিরোমণি ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনদের এককাট্টা করে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এই জন্য ইংরেজদের কোপে পড়েন রানি। তাঁকে বন্দিও করা হয়। নাড়াজোলের রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় চরম সাজা না হলেও তাঁকে আবাসগড়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
‘রানি শিরোমণির গড়’ হিসাবে পরিচিত ওই দুর্গের অবশ্য এখন কোনও অস্তিত্ব নেই। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শীর্ণকায়া পারাং নদী। তারপর পরিখাটুকু শুধু বোঝা যায়। মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে প্রাসাদ। ঝোপজঙ্গলের মাঝে গুটিকয় ইট পড়ে রয়েছে কেবল।
তবে মহামায়ার মন্দিরটি এখনও অটুট রয়েছেযেখানে বসে কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য সাধনা করতেন। প্রচলিত রয়েছে, এখানে বসেই রামেশ্বর শিবায়ন কাব্য রচনা করেছিলেন। রামেশ্বরের কাব্যে কর্ণগড়ের উল্লেখও রয়েছে‘রঘুবীর মহারাজা/ রঘুবীর সমতেজা /ধার্মিক রসিক রণধীর। যাহার পুণ্য ফলে/অবতীর্ণ মহীতলে/রাজা রামসিংহ মহাবীর’ বা ‘যশোবন্ত সিংহ/ সর্বগুণযুত/ শ্রীযুত অজিত সিংহের তাত। মেদিনীপুরাধিপতি/ কর্ণগড়ে অবস্থিতি/ ভগবতী যাহার সাক্ষাৎ।’
কর্ণগড়ের যাবতীয় আকর্ষণ এই মহামায়া মন্দিরকে কেন্দ্র করে। মন্দিরে মহামায়া ও দণ্ডেশ্বরের বিগ্রহ রয়েছে। উৎকল শিল্পরীতিতে তৈরি মন্দিরটিতে পঞ্চমুণ্ডির আসনও রয়েছে। কর্ণগড়ের নিসর্গও মনোরম। গাছগাছালি, নদী দিয়ে চারদিক ঘেরা। মেদিনীপুর শহর থেকে জায়গাটি খুব বেশি দূরেও নয়। তাই এক সময় এই এলাকাটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, রাস্তা তৈরি হবে, হবে পার্ক। |
অটুট রয়েছে মহামায়ার মন্দিরটি। |
গড়ের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে এলাকাটি ঘিরে ফেলা হবে। সেখানে রানি শিরোমণির কীর্তি ফলকে উৎকীর্ণ করা হবে। রাস্তা পাকা হওয়া বাদে বাকি সবই পরিকল্পনা স্তরে আটকে গিয়েছে। মন্দির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সেবা সমিতির সভাপতি সুকুমার সিংহ ও সম্পাদক তরুণ সাউ বলেন, “বিভিন্ন সময়ে নেতা-মন্ত্রীরা এসেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন কর্ণগড়কে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়তে উদ্যোগী হবেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। আমরা চাই, ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে সকলের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগী হোক সরকার।”
মেদিনীপুরের বিধায়ক তথা খড়্গপুর-মেদিনীপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতি বলেন, “আমরা ওই এলাকা উন্নয়নের একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছি নগরোন্নয়ন দফতরে। দেখা যাক কী হয়।”
পরিকল্পনা-প্রস্তাবের স্তর পেরিয়ে কাজ শুরু হবে কবে, সেটাই জানতে চান এলাকাবাসী। |
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
|
|