প্রবন্ধ ২...
আম আদমি ঝিমিয়ে পড়লেই যে কে সেই
তুন বছরে পুরনো বই নতুন করে পড়া সুখকর নিত্যকর্ম হতে পারে। ‘নিত্যকর্ম’ শব্দটা প্রথম শিখেছিলাম বাড়িতে ঠাকুরের তাকে রাখা ‘বিশুদ্ধ নিত্যকর্ম পদ্ধতি’ থেকে। ‘ডে টু ডে প্র্যাকটিস’ শব্দটি তখন সে বয়সে ছিল অচেনা। বাঙালি পরিবারে কিছু দিন আগেও এই জাতীয় বই থাকত। তবে নিত্যকর্ম তো শুধু ঠাকুর ঘরের নয়। তার বাইরেও শব্দটির একটা ‘বড়’ মানে থাকতে পারে। যেমন গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথ এঁদের লেখায় নিত্যদিন যাপনের ক্ষেত্রে নানা বিষয় অনুশীলনের কথা আছে। কেবল নিজের জন্য নয়, কী করলে সামাজিক ও জাতীয় জীবনের উন্নতি হতে পারে তা ছিল এঁদের লক্ষ্য। গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথ, দুজনের চিন্তায় নানা পার্থক্য ছিল, প্রত্যেক দিনের অভ্যেস কী কী হবে তার তালিকাও দুজনের ক্ষেত্রে হয়তো আলাদা। কিন্তু এক বিষয়ে দুজনে সহমত রাজনীতিসচেতন সমাজকর্মী হতে গেলে বড় বড় কথা বলে লাভ নেই, প্রত্যেক দিন কতকগুলি কাজ প্রয়োজন মতো সচেতন ভাবে করতে হবে। পল্লি উন্নয়ন সংক্রান্ত একাধিক লেখায় রবীন্দ্রনাথ কথাটা লিখেছিলেন। বোলপুর শহরে এক বার পেয়াদা আর চৌকিদার ‘তরলাবস্থায় রাত্রে পথ দিয়ে চলছিল’। এ সময় ডাকাতের গুজব ছড়ায়, মারামারির উপক্রম। বোলপুর শহর নাকি তখন দরজায় স্ক্রু আঁটল, কেউ বা টাকাকড়ি নিয়ে মাঠে লুকোল, শান্তিনিকেতনে সস্ত্রীক এসে আশ্রয় নিল, কিন্তু কেউ সমস্যার মুখোমুখি হল না। নিজেদের নিত্যদিনের জীবনে বিপদ এলে যে সচেতন হয়ে তার মুখোমুখি হতে হয়, এ বিশ্বাস শান্তিনিকেতনের ছেলেদের ছিল। তারা লাঠি হাতে ছুটল বোলপুর। বোলপুর বাজারে যখন আগুন লেগেছিল, তখনও একই কাণ্ড। আশ্রমের ছেলেরা আগুন নিভিয়ে দিল। কলসি দিয়েও বোলপুর তাদের সাহায্য করেনি। শুধু যে বিপদ এলেই আটকাতে হয় তা নয়, গঠনমূলক কাজও নিত্যকর্ম জলাশয় সংস্কার, ম্যালেরিয়া দমন, নৈশ শিক্ষালয় স্থাপন, কাজের কি শেষ আছে! রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা দেখে যাননি, কিন্তু মানুষের নিত্যদিনের অংশগ্রহণে সমাজ ও জাতির শরীর-মন ভাল থাকে, আর সেটাই যে বড় অর্থে রাজনীতি, এ কথাটুকু বোঝাতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছিলেন, গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন স্বনির্ভর স্বদেশি সমাজ। পুরোপুরি স্বনির্ভর না হোক, প্রতি মুহূর্তে এ বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। এটা বোঝানোর জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন প্রতিদিনের জীবনের ঘটনার নানা উদাহরণ।
গাঁধীবাদী নির্মলকুমার বসুর ‘গণতন্ত্রের সংকট’ (সূত্রধর) নামের প্রবন্ধ সংকলন নতুন চেহারায় বেরিয়েছে। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দল কংগ্রেস তখন ক্ষমতায় এসেছে। কেন্দ্রে কংগ্রেসি সরকার, পশ্চিমবঙ্গেও। নানা বিচ্যুতি সেই সরকারের শরীরে জমে উঠছে। কমিউনিস্টরা তখন কংগ্রেস-বিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই পটভূমিতে নির্মলকুমার তাঁর নিবন্ধগুলি রচেছিলেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর চিন্তাধারা মেলে না। কমিউনিস্টরা যে ‘সশস্ত্র’ বিপ্লবী সংগ্রামের স্বপ্ন দেখেন, ‘অহিংস’ নির্মলকুমারের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অথচ ‘কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই নানাবিধ দোষ’। নির্মলকুমারের জিজ্ঞাসা, ‘মূল রোগই বা কী? তাহার প্রতিকারই বা কী?’ প্রত্যেক দিনের জীবন থেকে ছোট ছোট উদাহরণ দিয়েছেন। আম আদমিকে এই সমস্যা ভোগ করতে হত, ফলে তারা বুঝবে। বুকিং ক্লার্ক আছেন, কিন্তু টিকিট দিচ্ছেন না। অসৎ কেরোসিনের তেলওয়ালার মোটরে করে কংগ্রেসি মন্ত্রী এসে রামধুন গান গাইয়ে গাঁধী ফান্ডে চাঁদার জন্য বক্তৃতা করে গেলেন। কোনও বাঁধ তৈরি করার সময়, স্কুল বা হাসপাতাল গড়ার সময় যোগ্য লোকেদের চাইতে স্থানীয় কংগ্রেসিদের মতই বেশি গুরুত্ব পায়। নন্তুবিহারী নস্কর পরাধীন দেশে চরকা কেটেছিল, জেলে গিয়েছিল, সেই সুবাদে স্বাধীন দেশে তার জয়জয়কার। চেনা মন্ত্রীদাদার জন্য টাটকা মোরব্বা, কদমা, খদ্দরের মিহি ধুতি নিয়ে নন্তু তার অঞ্চলের কোনও কাজ উদ্ধারের জন্য কলকাতা চলল। নন্তুবিহারীকে আগামী ইলেকশনের কথা ভেবে মন্ত্রীদাদা চটালেন না। অর্থাৎ রোগটা হল বিস্মৃতির সরকার আর পার্টি যে এক নয়, তা ক্ষমতা বজায় রাখতে চাওয়া মন্ত্রী-দাদা ভুলে যান। আর এই ভুলে যাওয়াটাকেই নানা ভাবে ব্যবহার করেন পার্টি আদমিরা। স্বজনপোষণ, দুর্নীতি আর রোজ যাঁর যা করার কথা তা না-করাই তখন দস্তুর। নির্মলকুমার এই রোগের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, এর দাওয়াই হল আম আদমির প্রত্যেক দিনের সচেতনতা। নিজে সচেতন থাকা, অন্যকে সচেতন করা। বাঁকা উপায়ে টিকিট কাটবেন না, নন্তুবিহারীকে ধরে কাজ আদায় করবেন না। গাঁধীবাদ আর দলপুষ্টি এক নয়। গাঁধী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছিলেন। দলকে যেমন তেমন ভাবে ক্ষমতায় রাখতে চাননি। প্রত্যেক দিন নিজে সচেতন থেকে অংশগ্রহণ করে পরিপার্শ্বকে সজীব রাখাই ‘সত্যাগ্রহ’। সরকারকে মনে করিয়ে দিন সে ক্ষমতার কেন্দ্র নয়, আম আদমির প্রতিনিধি। মন্ত্রী আর নেতারা জনসেবক। এমনিতে ভুলে যাবেন, চাপ দিলে মনে থাকবে।
গাঁধীবাদী নির্মলকুমারের বইটি পড়ে মনে হয় রোগ আর রোগের প্রতিকার তিনি নির্দেশ করেছিলেন। আম আদমির বড় অংশ অবশ্য থেকে থেকেই ঝিমিয়ে পড়েন। ফলে তিনি কংগ্রেসি সরকারের যে রোগগুলি নির্দেশ করেছিলেন, তা পরবর্তী সরকারেও বর্তেছিল। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ দিন বামপন্থীরা শাসনে ছিলেন। জনগণের সরকার নয়, সেখানেও ক্রমে দল ও দলের স্বার্থই বড় হয়ে উঠেছিল। বামেরা বিদায় নিয়েছেন। অন্য সরকার এখন। সেখানেও কিন্তু পার্টি আদমি বড়, আম আদমি নয়। আর জনসাধারণ? মোক্ষম একটা ছবি এঁকেছেন নির্মলকুমার। ‘জনসাধারণ যে জগন্নাথের রথের মতো গতিতে চলে’ এক জায়গায় অনেক ক্ষণ আটকে রইল, তার পর হেঁচকা টান। হঠাৎ হেঁচকা টানে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে চলা। আবার থামা। এক জায়গায় আটকে যাওয়া। তাঁর উপমা বিস্তার করলে বলা চলে, হেঁচকা টানের সময় এক পার্টি গেল, আর এক পার্টি এল। কিন্তু টানের পরেই আম আদমি ঝিমোয়। ফলে সরকার দল হয়ে যায়। কংগ্রেস-বামজোট-তৃণমূল, এক গল্প। তাই এ ভাবে হবে না। সচেতন থাকা, প্রতিবাদ করা, নিজের কাজ ঠিক মতো পালন করাই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে আম আদমির নিত্যকর্ম পদ্ধতি। পুঞ্জীভূত দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করার এটাই উপায়।

লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.