বর্ষশেষের পার্ক স্ট্রিটে কেউ খুঁজলেন মণ্ডপ,
কেউ বা নিলেন ভূমিশয্যা
র্ষবরণের রাতে আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রিট মনে করিয়ে দিচ্ছিল অষ্টমীর সন্ধ্যা। ভিড় ঠেলে সপরিবার এক ব্যক্তি এসে সটান জিজ্ঞেস করে ফেললেন, “স্যার, প্যান্ডেলটা কোন দিকে?” প্রশ্ন শুনে হতচকিত পুলিশ। প্যান্ডেলের সন্ধান দিতে না পারলেও, হাত দেখিয়ে অ্যালেন পার্কে আলোর সাজের দিকে যেতে বললেন দায়িত্বরত পুলিশকর্মী। মঙ্গলবার রাতের পার্ক স্ট্রিটের জনস্রোত তখন সে দিকেই এগোচ্ছে।
বছরের শেষ রাতে পার্ক স্ট্রিটের জনজোয়ারে ছিলেন নানা শ্রেণির মানুষ। খাস কলকাতার জেন ওয়াইয়ের ভিড় তো ছিলই, সঙ্গে ছিল প্রথম বার পার্ক স্ট্রিট দেখতে আসা নানা অঞ্চলের মানুষও। ‘দাদা, পার্ক স্ট্রিটটা কোন দিকে?’ খোদ পার্ক স্ট্রিটের বুকে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্নেরও জবাব দিতে হয়েছে পুলিশকে। এমনই বৈচিত্রের মাঝে এ বার নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে শহর কলকাতার এই প্রাণকেন্দ্র।
হইচই শুরু হয়েছিল সন্ধ্যা থেকেই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে সেই উচ্ছ্বাস-উন্মাদনার পারদ। কিন্তু কড়া হাতে রাশ টেনে রেখেছিল পুলিশ। তাই ছোটখাটো দু’একটি অশান্তি ছাড়া মোটের উপরে শান্তিপূর্ণ ভাবেই কাটল শহরে বর্ষবরণের রাত। পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ২০১৪-কে স্বাগত জানালো আট থেকে আশি।
ফি বছরের মতো বিকেল থেকেই এই এলাকায় ভিড় জমাতে শুরু করে জেন ওয়াই। বছরের শেষ সূর্যাস্তের পরেই রঙিন আলোয় ঝলমলে হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মানুষের ঢল। রাত বাড়তেই বেড়েছে সান্তা টুপির ভিড়।
ঘড়িতে তখন ১১টা ৫৫ মিনিট। আচমকাই শান্ত হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটের দু’পাশের ফুটপাথ। মাত্র ৫ মিনিট! তার পরেই উচ্ছ্বাস, আতসবাজি ও ভুভুজেলার শব্দে তাল কাটল নীরবতার। পার্ক স্ট্রিটের আকাশ-বাতাসে তখন একটাই সুর, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’।

খানাপিনা আর হুল্লোড়ের পরে বেসামাল তিন যুবক।
মঙ্গলবার রাতে, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
এমন সময়েই অ্যালেন পার্কের সামনে পুলিশের ওয়াচ টাওয়ার থেকে রাস্তায় পড়ল নীল-লাল-সবুজ-সাদা রঙের স্পট আলো। আলোর ভেলায় নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিতে চেয়ে পুলিশের ব্যারিকেড অগ্রাহ্য করেই ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তার মাঝে নেমে এল ঢল। মিনিট পাঁচেকের সেই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে আটকে গেল পার্ক স্ট্রিটের গাড়ি। শেষে আনন্দে মশগুল সব্বাইকে কার্যত ধাক্কা মেরে ফুটপাথে তুলে দিল পুলিশ। পুলিশের ধাক্কা খেয়ে ফুটপাথে উঠে আড়িয়াদহের ঝন্টু পাল বললেন, “রাস্তায় নামাই যখন নিষেধ, তখন টাওয়ার থেকে আলো ফেলা কেন?”
বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিটে আসা মানুষদের হাঁটতে হয়েছে পুলিশের ছকে দেওয়া রুট ধরেই। যেমন হয় দুর্গা পুজোর সময়ে। লালবাজারের এক পুলিশকর্তা বলেন “প্রতি বছরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে এ বছর ফারাক আছে।” তিনিই জানান, অন্য বার লোকজন রাস্তা দিয়েও হাঁটতে পারতেন। ফলে গোটা পার্ক স্ট্রিট জুড়ে লোকারণ্য হয়ে যেত। আর তাতেই শ্লীলতাহানি, পকেটমারি মতো বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত সহজে। কিন্তু এ বছর প্রথম থেকেই পরিকল্পনাটা পাল্টে ফেলেছিলেন লালবাজারের কর্তারা।
পুলিশের পরিকল্পনা মতো, এ বার পার্ক স্ট্রিটে আসা লোকজনকে চলতে হয়েছে নির্দিষ্ট ফুটপাথ ধরেই। রাস্তা পারাপারের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল কয়েকটি পয়েন্টকে। সেখানেও ছিল পুলিশ। ফলে রাস্তাটা ফাঁকাই ছিল। সেখান দিয়েই চলেছে যানবাহন। গভীর রাত পর্যন্ত একমুখী রাখা হয়েছিল পার্ক স্ট্রিট। এ ছাড়াও কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ সব কর্তাই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা এলাকা। সঙ্গে ছিল উর্দিধারী পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ। ফুর্তির আতিশয্যে বেসামাল হয়ে অভব্য আচরণের জন্য বর্ষবরণের রাতে গোটা শহরে গ্রেফতার হয়েছেন মোট ২৭২ জন। তবে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বলেন, “সব মিলিয়ে সুষ্ঠু ভাবেই মিটেছে বর্ষ শেষের রাত।”
রাত সাড়ে ১১টা থেকে আরও তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ। রাসেল স্ট্রিট থেকে বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে আসা যুবকদের অ্যালেন পার্কের দিকে সোজা যেতে না দিয়ে এক প্রকার জোর করেই মির্জাগালিব স্ট্রিটের দিকে ঢুকিয়ে দিতে শুরু করল। আবার ক্যামাক স্ট্রিটের দিক থেকে আসা ভিড়কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মিডলটন রো-এর দিকে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ হতেই বাঁধ ভাঙল মির্জা গালিব স্ট্রিটের দিকে জটলা করে থাকা যুবকেরা। পুলিশি ব্যারিকেড উপেক্ষা করে রাস্তার মাঝে আসতে গিয়ে উপড়ে ফেলল একটা টেলিফোনের বড় যন্ত্রাংশের বাক্স। এর পরেই লাঠি হাতে ওই যুবকদের তাড়া করল পুলিশ। কয়েক জনের পিঠে কয়েক ঘা যে পড়ল না, তা কিন্তু নয়। হঠাৎ লাঠিচার্জ কেন? কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বললেন, “এমন সব ছেলেদের ছেড়ে দিলে কী হত বলুন তো?”
তবে রাত দেড়টার পর থেকে ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে চেনা পার্ক স্ট্রিট। ভিড় কমে রেস্তোরাঁয়। কেউ কেউ সঙ্গীকে নিয়ে হাতে হাত রেখে কিছুক্ষণের জন্য বসে পড়ে বন্ধ দোকানের সিঁড়িতেই। কিন্তু সেখানে বাদ সাধে পুলিশ। বিকেল থেকে রাত ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে জটলা করে বেশি হইহুল্লোড় করলেই মিলেছে পুলিশের কড়া চোখ রাঙানি। কারও কারও ঠাঁই হয়েছে পুলিশের জিপে। বেপরোয়া বাইক-বাহিনীকেও কড়া হাতে শায়েস্তা করেছে পুলিশ।
বেশি রাতে উত্তেজনার পারদ কিছুটা পড়লেও কমেনি উন্মাদনা। মত্ত অবস্থায় পানশালা থেকে বেরিয়ে নামী হোটেলের সামনে ফুটপাথেই শুয়ে পড়েন এক যুবক। বন্ধুকে সেখানে ঘুমোতে দেখে তাঁর পাশেই শুয়ে পড়েন আরও এক জন। এই দৃশ্য দেখে সেই দলের তৃতীয় ব্যক্তিও রাতের মতো ঠিকানা খুঁজে নিলেন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটপাথের ধারে। এই কাণ্ড খেয়াল করেই তাঁদের টেনে তুলতে দৌড়ে গেল পুলিশ। তত ক্ষণে তিন যুবকই নিদ্রা গিয়েছেন। অনেক ডেকেও ঘুম ভাঙানো যায়নি কারও।
কিন্তু জেগেছে মায়াবি পার্ক স্ট্রিট। বলেছে, আসছে বছর আবার হবে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.