বচ্ছরকার দিনের ভিড়টার কথা ভালই জানা ছিল তাঁর। কিন্তু হাতে-কলমে সেটা পরখ করা কী জিনিস, তা এ বার টের পেলেন। ছেলের আব্দারে ‘জু গার্ডেন’ দেখাতে এনে আমেরিকাপ্রবাসী সুনন্দা সেন কলকাতার মিঠে শীতেও প্রায় গলদঘর্ম। বুধবার বিকেলে সুনন্দাদেবী বলছিলেন, “মনে হচ্ছে, গোটা গ্রামবাংলাই যেন সুনামির মতো এখানে আছড়ে পড়েছে!” বাস্তবিক, আদৌ বাড়িয়ে বলেননি সুনন্দা। ২০১৪-র প্রথম দিনটি আক্ষরিক অর্থেই আলিপুর চিড়িয়াখানার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চিড়িয়াখানায় ভিড়ের নিরিখে তিন দশকের পুরনো একটি রেকর্ড এত দিনে চুরমার! অধিকর্তা কানাইলাল ঘোষ বিকেলে হিসেব দিলেন, যা দেখা যাচ্ছে ৯০ হাজার ৯৮৯ জন এ দিন বেড়াতে এসেছিলেন চিড়িয়াখানায়। তিন দশক আগে ১৯৮৪ সালের জুলাইয়ে এক দিন ৮৯ হাজারের বেশি জনতা চিড়িয়াখানায় ভিড় করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিল ব্রিগেডে তৎকালীন শাসক দলের কোনও সমাবেশের উপলক্ষ। সাধারণ ছুটির দিনে এমন ভিড় চিড়িয়াখানায় আগে হয়নি। গত বড়দিনেও জীবজন্তু দেখতে গিয়েছিলেন ৮১ হাজার ৪১৭ জন। কিন্তু সেই নজিরও এখন অতীত। শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স বা একেলে বিনোদনে ভরপুর হালফ্যাশনের অজস্র ঝকঝকে পার্ক থাকা সত্ত্বেও চিড়িয়াখানার আবেদন যে এখনও অটুট, তা ভালই বোঝা গিয়েছে।
বছরের শেষ রাতের মেজাজের সঙ্গে পয়লা জানুয়ারির মেজাজটা কলকাতায় বরাবরই আলাদা। বর্ষশেষের রাতে পার্ক স্ট্রিটের উদ্দাম উল্লাসের পরে শহর যখন নিতান্তই গেরস্ত পারিবারিক। সাত-সকালের মেজাজটা ধার্মিক, ভাবগম্ভীরও বলা যায়। কাশীপুর উদ্যানবাটির সামনের লাইনটা সাপের মতো ঘুরতে ঘুরতে কিলেমিটারটাক দূরের বিটি রোড অবধি ছুঁয়ে ফেলেছে। ভিড় থাকলেও সেখানে প্রিয়জনের মঙ্গলচিন্তায় আকুল প্রার্থনার নৈঃশব্দ্য। |
কাকভোরে উঠে কাশীপুর উদ্যানবাটী, দক্ষিণেশ্বর মন্দির বা কালীঘাটের মতো ময়দান, মিলেনিয়াম পার্ক, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে যাওয়ার ট্র্যাডিশনও চলেছে। ভিড় টেনেছে সিঁথি, পার্ক সার্কাস, পাটুলির মাঠের সার্কাসও। ভিড়ের মাসুলও কম-বেশি দিতে হয়েছে। যেমন, চিড়িয়াখানায় কানাইলালবাবু আফশোস করছিলেন, জনতার দৌরাত্ম্যে বাগানের ভিতরের কয়েকটি ঘেরা অংশের বাহারি ঘাসের দফা রফা। রীতিমতো পাঁচিল টপকে ভিতরের সাজানো বাগানে নরম ঘাসের উপরে বসে লুচি-আলুর দম চাখার নেশায় সামিল আবালবৃদ্ধবণিতা। জঞ্জালে ভরে ওঠা ধ্বস্ত চিড়িয়াখানা-চত্বরে দাঁড়িয়েই কানাইলালবাবু বলছিলেন, “২০১৪-তেও আর যা-ই হোক, পরিবেশের বিষয়টায় এখানকার লোকে সচেতন হল না!”
নতুন বছরের কলকাতার মেনুতে অবশ্য অনেক নতুনেরও ছড়াছড়ি। নিউ টাউনের ইকো-ট্যুরিজম পার্ক থেকে নতুন শপিং মল-মাল্টিপ্লেক্স— সর্বত্রই উদযাপনের ঘটা। ‘চাঁদের পাহাড়’ বনাম ‘ধুম থ্রি’র টক্করটা তাই পয়লা জানুয়ারিতেও জারি থেকেছে। অনেক বছর বিচ্ছিন্ন পুরনো স্কুল-কলেজের বন্ধুদের মোলাকাতের জন্যও এমন দিন দিব্যি। বছরের এই সময়টায় এখন প্রবাসী অনেক কলকাত্তাইয়াও শহরে ফেরেন। নেটমাধ্যমে তোড়জোড় সেরে এমন পুরনো পাপীরা ইতি-উতি একজোট হয়েছে।
তবে এই ২০১৪-য় দাঁড়িয়ে যে যা-ই করুক, তা ফলাও করে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে না-জানালে কিন্তু কোনও কিছুরই যেন মানে হয় না। ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে, তা-ই দুপুর থেকেই ভুরিভোজের ঘোষণা। কেউ চিনেপাড়ায় ভালমন্দ সাঁটাচ্ছেন, তো কেউ পার্ক স্ট্রিটে টার্কি আস্বাদনের সচিত্র উল্লাসে মাতোয়ারা। একটু উঁচকপালে জনগণ, আগে থেকে ভেবে-চিন্তেই ক্লাব বা প্রিয় রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজের পরিকল্পনা সেরে রেখেছিলেন। আর কাছের-দূরের মফস্সলের জন্য ময়দানের পিকনিকে ওপেন এয়ার ভুরিভোজের বন্দোবস্ত তো আছেই। খেতে খেতে কি ঘুরতে ঘুরতে ভিড়-হট্টগোলের ফাঁকে মোবাইল ক্যামেরায় অপটু হাতের তোলা ছবি ছাড়া কোনও আনন্দেরই যে ঠিক ষোলো কলা পূর্ণ হয় না, ২০১৪ সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছে।
চেনা-অচেনা ভুলে পাঁচ জনকে দেখাতে নিজের হাতে তোলা নিজের ছবির কথা বলতে ইতিমধ্যেই ইংরেজিতে একটি শব্দ চালু হয়েছে। সেল্ফি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এমন আত্মরতি কি ২০১৪ সালে বাংলায় কোনও সমার্থক শব্দ খুঁজে পাবে?
সে তো পরের কথা, আপাতত বছরের প্রথম দিনটা আনন্দে কাটাতেই প্রাণপণ অঙ্গীকার। শুরুটা ভাল হলে, বাকিটাও ভাল যাবে! এই বিশ্বাসটুকুই অনেকেরই সম্বল। |