|
|
|
|
|
|
সিইও-র টেবিল থেকে |
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লগ্নি করা উচিত ব্যালান্সড ফান্ডে
আইসিআইসিআই-প্রুডেন্সিয়ালের এমডি এবং সিইও নিমেষ শাহের সঙ্গে আলাপচারিতায় সুপর্ণ পাঠক |
|
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আপনি মন্তব্য করেছেন যে, সঞ্চয়কারীকে বুঝতে হবে কোন শিল্প ভাল করবে। প্রশ্ন হল, সাধারণ সঞ্চয়কারী যদি এটাই বুঝবেন, তা হলে তিনি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করবেন কেন? আরও এক পা হেঁটে বিনিয়োগের উপযোগী শেয়ার তো তিনি নিজেই বেছে নেবেন?
দেখুন, বাজারের একটা নিজস্ব যুক্তি আছে। সাধারণ মানুষ বাজারে ঢুকতে চান, যখন বাজার গরম। চোখের সামনেই উদাহরণ দেখুন। আজ যাঁরা ক্ষতির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ২০০৭ নাগাদ শেয়ার কিনতে শুরু করেন, যখন সেনসেক্স বা নিফ্টি বেশ চড়া। আবার লক্ষ করবেন, গত কয়েক বছরে প্রচুর মুনাফা করেছে রিয়েল এস্টেট (আবাসন শিল্প)। ফলে তার অংশীদার হতে সাধারণ সঞ্চয়কারীরাও ভিড় জমিয়েছিলেন সেখানে।
সুতরাং আমি যা বলতে চাইছি তা হল, যে কোনও ক্ষেত্র (তা ব্যাঙ্কিং হোক বা কয়লা), লাভ করে ফেললে, তবে তাতে বিনিয়োগের জন্য ভিড় জমান সাধারণ মানুষ। কিন্তু যখন যান, তত দিনে হয়তো ওই সব শিল্প তাদের লাভের বৃত্তে এমন একটা জায়গায় পৌঁছিয়ে গিয়েছে যে, সেখানে নতুন করে শেয়ারের দামে মুনাফার অঙ্ক সে ভাবে হেরফের হওয়ার সুযোগ খুব একটা থাকে না।
গত কয়েক বছরে সোনা, ব্যাঙ্ক আমানত আর আবাসন ও নির্মাণ ক্ষেত্রকেই সঞ্চয়ের গন্তব্য হিসেবে দেখেছেন সাধারণ মানুষ। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন শেয়ার থেকে। পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন, শেয়ার বাবদ যে-তহবিল মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের হাতে আছে, তার পরিমাণ কমেছে।
পাঁচ বছর আগে ব্যাঙ্কে ২৮ লক্ষ কোটি টাকা আমানত হিসেবে জমা ছিল। আজ সেই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৭০ লক্ষ কোটিতে। সেখানে মিউচুয়াল ফান্ডের দিকে তাকান। পাঁচ বছর আগে সেখানে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ তহবিল ছিল ৫ লক্ষ কোটি টাকা। সেখানে আজ তা কমে গিয়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি।
অর্থাৎ সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে শেয়ার তার জায়গা হারিয়েছে। অথচ সূচক যখন নীচে, তখন সঞ্চয়কারী শেয়ারে টাকা রাখলে, পরে সূচক উপরে ওঠার ফায়দা নিতে পারতেন। পুরো লাভই তাঁর পকেটে যেত।
এই তথ্যের ভিত্তিতেই আমি বলেছি, সবাই যখন কোনও শেয়ার কিনছেন, তখন সেটাই না-কিনে বিনিয়োগের জন্য বাছা উচিত সেই শিল্প, যা লাভের রাস্তায় হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কখন বিনিয়োগ করবেন, সেই সময় বাছাটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে-সমস্ত ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই মুনাফার রাস্তায় অনেকখানি হেঁটে ফেলেছে, সেখানে টাকা ঢাললে ততটা আয় না-ও হতে পারে।
শেয়ার বাজারে টাকা ঢালতে যদি এত জ্ঞানের দরকার হয়, তা হলে সাধারণ মানুষ শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন কেন?
করবেন। কারণ, শেয়ারে বিনিয়োগ করলে তবেই আয় বাড়ার হার মূল্যবৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে যেতে পারবে।
সঞ্চয় করার সময়ে সাধারণত আমরা শেয়ারেই সব থেকে কম টাকা রাখি। আমার মতে, এটা ঠিক নয়। কারণ, শেয়ার এড়িয়ে সঞ্চয় পরিকল্পনা করলে, আয় আশানুরূপ বৃদ্ধি হওয়া অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম রিটার্ন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
|
|
সঞ্চয়কারীদের মধ্যে এই সব প্রকল্প নিয়ে এখনও নানা প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, ফান্ডে মাসিক কিস্তিতে বিনিয়োগ (এসআইপি)। কী ভাবে এসআইপি করবেন, তা নিয়ে এখনও ধারণাই গড়ে ওঠেনি। সেই সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকেই এত কিছু আশা করাটা কি ঠিক?
দেখুন, সারা দেশে আমাদের ১২০টি অফিস আছে। প্রতিটি অফিস বিনিয়োগকারীদের এই বিষয়ে তথ্য জুগিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করে।
এ ছাড়াও আমরা বিনিয়োগের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিজ্ঞাপন দিই। কথা বলি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে। উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের কাছে লগ্নির এই সব নানা দিক তুলে ধরা।
আজ প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যমেই ব্যবসার পাতা আছে। বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিটি মানুষকে আমি বলব নিয়মিত ওই পাতায় চোখ রাখতে। আস্তে আস্তে ব্যবসার জগৎ এবং তার সম্ভাবনা নিয়ে ধারণা গড়ে তুলতে যা অত্যাবশ্যক।
এই মুহূর্তে সূচক বেশ উঁচুতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূলে আছে মাত্র কয়েকটি শেয়ার। তাঁরা এটা-ও বলছেন, সূচক যে- উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে, তার সঙ্গে শিল্পের বাস্তব অবস্থার কোনও মিল নেই। এই পরিস্থিতিতেও শেয়ারে টাকা রাখার কথা বলবেন?
হ্যাঁ। দেখুন, বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি নিফ্টি সূচকের অন্তর্ভুক্ত মাত্র ১৫টি সংস্থায় টাকা ঢালছে। আমি পেশাদারি কারণে তাদের নাম বলব না। কিন্তু তার বাইরে অনেক শেয়ার আছে, যাদের ভবিষ্যৎ ভাল কিন্তু তারা বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ, বাজার এখন মেরুভূত। সুতরাং এটাই সুযোগ। নিফটি সূচকের বাকি ৩৫টি শেয়ার যে-দামে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এখন বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতে ভাল লাভ হবে।
এর বাইরে মাঝারি দামের মিড ক্যাপ শেয়ারের পুরো বাজারও বিনিয়োগের জন্য বড় সুযোগ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে।
সুযোগ কারণ, ওই ১৫টি শেয়ার ছাড়া বাকি শেয়ার এখনও বেশ সস্তা। কোনটা সস্তা বা দামি, তা দেখতে কিছু অনুপাত ব্যবহার করা হয়। যেমন প্রাইস আর্নিং (পিই) রেশিও, প্রাইস টু বুক ভ্যালু রেশিও ইত্যাদি।
কোনও শেয়ারকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিল্পের অবস্থা থেকে আলাদা করে দেখা উচিত নয়। আমরা তাই বিভিন্ন শিল্পের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখি। তার সঙ্গে মিলিয়েই সেই ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারের দাম যাচাই করি এটা দেখতে যে, আজ যতটা দরে কোনও সংস্থার শেয়ার পাওয়া যাচ্ছে, আগামী দিনে তা কী রকম বাড়তে পারে। কারণ, শেয়ারের দাম বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে অন্যতম সংস্থার আর্থিক অবস্থা।
আজ যদি লগ্নি করি, তা হলে আমি সেই শেয়ারগুলোই কিনব, সম্ভাবনার তুলনায় আজ যার দাম বেশ কম।
আর আমার মতে, ঠিক এখানেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে মিউচুয়াল ফান্ডের গুরুত্ব। সাধারণ মানুষের পক্ষে এত কিছু দেখে লগ্নি করা সম্ভব নয়। তাই এই দায়িত্বটা ফান্ডে লগ্নি করে তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল।
কোন ফান্ডে বিনিয়োগ করব, তা জানব কী ভাবে? ইউএস ৬৪-এ হাত পুড়িয়ে প্রচুর মানুষ ফান্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এখন বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি আছে। প্রতিটি ফান্ড সেবি-র নজরাধীন। তা ছাড়া, রেটিং এজেন্সি রয়েছে। যারা প্রতিটি ফান্ডের গুণমান বিচার করে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উচিত টাকা ঢালার আগে এদের রিপোর্ট দেখে নেওয়া। সময় বদলেছে। সাধারণ মানুষ এখন এই সব রিপোর্ট দেখে নিজেদের পছন্দ সাজিয়ে নিতে পারেন।
আমার ধারণা, বাজার এখন বেশ কিছু দিন অশান্তই থাকবে। তার মধ্যেও এমন বেশ কিছু শেয়ার রয়েছে, যেগুলিতে লগ্নি করা উচিত।
এখন এমন ফান্ড আছে, যেখানে বিনিয়োগ করলে, সেই তহবিল বাজার উপরে গেলে শেয়ার বিক্রি করে ঋণপত্রে বিনিয়োগ করবে। আবার পড়লে, সেই বিনিয়োগ ফিরবে শেয়ারে। ফলে লগ্নির ঝুঁকি কমবে। আসলে এই ব্যালান্সড ফান্ডগুলি তৈরিই হয়েছে ওই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে।
মনে রাখতে হবে, ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা রাখলে, আজ যে- সুদে টাকা রাখবেন, সেই হারেই আয় করবেন। কিন্তু ঋণপত্রের মজা হল, সুদের হার কমলে ঋণপত্রের দাম বাড়বে। আজ সুদের যা-হার, তা আগামী দিনে কমতে বাধ্য। সুতরাং এখন ঋণপত্রের ফান্ডে বিনিয়োগ করলে, আগামী দিনে বড় লাভের দরজা খুলতে পারে। আজ হয়তো সরকার ৯ শতাংশের বেশি সুদে ধার করছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা করা সম্ভব নয়। ফলে সুদ কমতে বাধ্য। আমার পরামর্শ, সেই সুযোগ কাজে লাগান।
আমি একটা কথা বলব, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যালান্সড ফান্ডে লগ্নি করা উচিত। যাতে তাঁদের শেয়ার ও ঋণপত্র, এই দু’টি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের সুযোগ থাকে এবং ঝুঁকিও তুলনায় কম রাখা যায়। |
যা ঘটে |
• সাধারণত সঞ্চয়কারীদের মোট সঞ্চয়ের মাত্র ২২% শেয়ারে থাকে।
• মিউচুয়াল ফান্ডে সঞ্চয়ের ৫৯ শতাংশ শেয়ারে খাটে।
• গত ১০ বছর ধরে যাঁরা ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ারে টাকা খাটিয়েছেন, তাঁদের লাভের হার ১৫.৪%।
• একই ধরনের সম্পদে (শেয়ার, ঋণপত্র, সোনা ইত্যাদি) পুরো টাকা ঢাললে, প্রায়শই তাতে
ঝুঁকি বেশি থাকে। কিংবা কম হয় রিটার্ন। তাই বহুমুখী তহবিলে টাকা ঢালাই বুদ্ধিমানের
কাজ।
তাতে ঝুঁকি আর রিটার্নের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য থাকে।
• ইতিহাস বলছে, সোনা, শেয়ার এবং ঋণপত্রের মধ্যে অন্তত দু’টি প্রায় সব সময়েই লাভ দিয়েছে। |
|
|
|
|
|
|