প্রবন্ধ ২...
উত্‌সব যাঁদের মনে অবসাদ নিয়ে আসে
ত্‌সবের মরসুম মানেই আনন্দের ঋতু। এবং অবসাদেরও। বিশ্বাস না হয়, মন-চিকিত্‌সকদের কাছে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। টানা ছুটির সময়ে তাঁদের চেম্বারে অবসাদে ভোগা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ে। বিশ্ব জুড়েই। একটা নামও আছে এই অবসাদের: ‘হলিডে ব্লুজ।’ ছুটির মধ্যেই গেঁথে থাকে সেই অবসাদের শিকড়। নানান সমীক্ষা অনুযায়ী, ইউরোপ-আমেরিকার বহু দেশে ক্রিসমাস-নিউইয়ারের ছুটির সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়।
কেন যাবে না? আলোর রোশনাই আর আইটেম নাম্বার থেকে দু’দণ্ড মনটাকে সরিয়ে নিয়ে ভাবুন তো সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁরা নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন, যাঁরা হুল্লোড়বাজি, ভিড়ভাট্টা একটু এড়িয়ে যেতে চান। ছুটির মরসুম মানেই তাঁদের বুক দুরদুর। টিভির পর্দায়, পাড়ার আলোচনায়, অফিসের গল্পে, খবরের কাগজের পাতায় তখন শুধু কত অসামান্য ভাবে ছুটি কাটানো যায় তার হাজারো ফিরিস্তি। কী খাওয়া বা কেনা যায়, কোথায় সবান্ধব যাওয়া যায়, আনন্দে কত পেগ ডুব দেওয়া যায় তার বিশদ বিবরণ। সেই একাকী মানুষগুলো ছুটি কাটানোর কোনও মারকাটারি পরিকল্পনা করে উঠতে পারেন না, ফলে প্রায় কুঁকড়ে, কান চাপা দিয়ে বসে থাকার উপক্রম হয়। ছুটিই তাঁদের ঘাড় ধরে আরও এক বার বুঝিয়ে দেয় যে, সুস্থ সামাজিক কাঠামোর চলতি সংজ্ঞায় তাঁরা একা, অস্বাভাবিক, বেমানান বা আপাংক্তেয়। নিজের মনের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রমশ বিষাদের গহনে চলে যেতে থাকেন তাঁরা।
পরিচিত এক অধ্যাপকের কথা মনে পড়ছে। পুজোর সময় উত্তর কলকাতার বাড়ির বারান্দায় সন্ধ্যা থেকে বসে থাকতেন। একা একা ঘোরা বড্ড বোকা বোকা, বিষম লাগত তাঁর। তাই রাস্তায় আলো দেখতেন, লোক দেখতেন, পোশাক জুতো হাসি ফুচকা-খাওয়া হাতের-বেলুন দেখতেন। ভেঁপু শুনতেন, শুনতে শুনতে কল্পনা করতেন নিজেও ওই ভিড়ের স্রোতে ভাসছেন, মজায় লুটোপুটি খাচ্ছেন। এই ভাবেই পুজো কেটে যেত। বড়দিনের ছুটিতেও একা একা ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে একা একা কেক খাওয়া। ৩১ ডিসেম্বর টেলিভিশনের সামনে বসে দেখা বিশ্বের কোন প্রান্তে কারা কত রকম ভাবে খুশিতে মাতোয়ারা। দেখতে দেখতে অপেক্ষা করা, যদি নিউইয়ার উইশ জানিয়ে কোনও ফোন আসে। অনেকটা যেন নিষ্ফল প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে-পড়া চ্যাপলিন।
আর একটি মেয়ে। তখন কিশোরী। পড়াশোনায় ভাল, সুন্দরী, বন্ধুহীন। বাবা ব্যস্ত মানুষ, উত্‌সবের সময়েও অফিস। মা সব সময় বাড়ি নিয়ে জড়িয়ে আছেন, বাইরে বেরোতে চান না। বোন বন্ধুবান্ধব নিয়ে চুটিয়ে মজা করে। কিশোরীরও সেজেগুজে হইহই করতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সঙ্গী পায় না। ভিতরটা দলামচা করে ওঠে, রাগ হয়, কান্না পায়। তার পর নামে অবসাদ। ঘরের অন্ধকারে সেঁধিয়ে উত্‌সবের আলো থেকে পালাতে চায় সে।
মনোবিদরা বলেন, ‘হলিডে ব্লুজ’-এর অন্যতম কারণ হল, যে ভাবে ছুটি কাটাতে চাইছি, যতটা আনন্দ করতে চাইছি, সেটা পারছি না। যদি আনন্দের আস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় তা হলে সেটা পূরণ না হওয়াই স্বাভাবিক। তাতেই সমস্যা বাড়ে। ছুটি এলেই তাকে ‘সর্বকালের সেরা’ বানানোর প্রবণতা থাকে অনেকের। শেষমেশ তা পূরণ হয় না, আশাভঙ্গে অবসাদ আসে। প্রথমত সব আনন্দের টার্গেট পূর্ণ হল না বলে অশান্তি, দ্বিতীয়ত ছুটি শেষ হয়ে আবার গতানুগতিক কাজের রুটিন শুরু হয়ে গেল বলে নিরাশা।
ছুটির ‘প্রায়রিটি’ ঠিক করাটা সবচেয়ে আগে দরকার। সেই সঙ্গে, এই ছুটিটাকেই আমাকে সর্বোত্‌কৃষ্ট বলে প্রমাণ করতে হবে এমন চিন্তা ভেঙে বেরোতে হবে। উত্‌সবের মরসুম ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক বার আসে। যথেষ্ট আনন্দ এ বার না হলে অন্য বার হবে। একমাত্র উত্‌সবের সময়েই যাবতীয় আনন্দ লুটে নিতে হবে এমন দিব্যিও তো নেই। বছরের অন্য সময়েও তা করা যায়। পাশাপাশি, ছুটি কাটাতে যা-যা মোচ্ছব করা যেতে পারে বলে কাগজে বা টেলিভিশনে ভূরি ভূরি বিজ্ঞাপন দেওয়া থাকে সেটা হয়তো আপনি করতে পারছেন না। তাতে নিজেকে অত্যন্ত অকিঞ্চিত্‌কর, বঞ্চিত, নন-অ্যাচিভারও মনে হতে পারে। কিন্তু লোকদেখানো উপায়ে নয়, নিজের মতো করেও উদ্যাপন হয়, আনন্দ হয়, আর সেটা মনকে বোঝানোর দায়িত্ব নিজেরই।
ছুটির আশাভঙ্গের অন্য প্রকারও থাকে। ধরুন মা-বাবা প্ল্যান করলেন, বর্ষশেষের ছুটির দিনটা মেয়ের সঙ্গে বাড়িতে হইহুল্লোড় করে কাটাবেন। একটু কেক, একটু ওয়াইন, মিউজিক, একসঙ্গে গল্প। কেক এল, ওয়াইনও। কিন্তু মেয়ের আগে থেকে বন্ধুদের সঙ্গে কোনও পার্টিতে যাওয়ার কথা। সে ‘সরি’ বলে কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল। অন্য পক্ষের চার পাশে তখন একটা একটা করে বাতি নিভতে থাকল। কিংবা ধরা যাক এক পরিবারে চার-পাঁচ জন সদস্য। সবাই নিজের নিজের পছন্দ অনুযায়ী ছুটি কাটাবেন ঠিক করেছেন। মধ্যবয়স্ক দম্পতি ভাবছেন, সবাইকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসবেন, তাঁদের বয়স্ক বাবা-মায়ের ইচ্ছা, এক বার দেশের বাড়ি গেলে হয়। সদ্যোযুবতী নাতনির ইচ্ছা ‘হানি সিং নাইট’ দাপিয়ে থার্টিফার্স্ট গালা-পার্টি মাতানো। কে কার মন রাখবে? কে নিজের ইচ্ছা বলি দেবে? মানবিকতার দায়ে কেউ যদি আত্মত্যাগ করেও, ভিতরে ভিতরে আফশোস হবে না তো যে, অমূল্য ‘মি টাইম’ হেলায় নষ্ট হল?
উত্‌সবের ছুটিতে বিচিত্র বিড়ম্বনায় পড়েন বহু বর্ষীয়ান মানুষ। যৌবনের বিভিন্ন ছুটি কাটানোর রঙিন স্মৃতি স্তূপ হয়ে রয়েছে তাঁদের মস্তিষ্কে। মন বারে বারে সেই ফেলে আসা মুহূর্তয় ফিরতে চাইছে। কিন্তু এখন পুরনো ভ্রমণসঙ্গীরা নেই, শরীরের সেই জোর নেই, বা টাকার। ছুটির মরসুম মানে তাঁদের কাছে হারিয়ে ফেলা সময়ের যন্ত্রণা নিয়ে মনের অ্যালবাম উল্টে চলা।
আরও বিড়ম্বনায় বৃদ্ধাশ্রম, বিধবাশ্রম, সংশোধনাগার বা আশ্রমের আবাসিকেরা। চারিদিকের ছুটির উত্‌সবে তাঁরা কেমন যেন দিগ্ভ্রান্ত, ব্রাত্য। এর মধ্যেই আবার রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সেবামূলক পরিকল্পনার চাপ। অমুক ছুটিতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মন ভাল রাখতে গানের ফাংশনে নিয়ে যাওয়া হল। তমুক ছুটিতে অনাথ বাচ্চাদের আনন্দ দিতে নিকো পার্ক ভ্রমণ হল। কোনও সংস্থা কি কখনও জানতে চেয়েছে যে, হোমের সব বৃদ্ধাদের ওই ফাংশনে যেতে ইচ্ছা করেছিল কি না? কারও হয়তো হোটেলে গিয়ে মদ্যপানের ইচ্ছা ছিল। কে তার খোঁজ রেখেছে? কিংবা কোনও বাচ্চার শখ ছিল নিকো পার্ক নয়, সে গড়ের মাঠে ক্রিকেট খেলবে আর ঘোড়ার গাড়ি চড়বে। কিন্তু অবস্থার পাকে তাদের ছুটিটা নিয়ন্ত্রিত হল অন্যের পরিকল্পনামাফিক। অনেকের কাছেই তাই ছুটি মানে বিভীষিকা, ছুটি এলেই তাঁদের মনপ্রাণ ছটফট করতে থাকে, কত তাড়াতাড়ি আবার রুটিনবদ্ধ হওয়া যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.