|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
বড় প্রশ্ন দুটি: উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার |
আছে কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া, নাগরিক উচ্চবর্ণের মোদী-অনুগমন, আবার আঞ্চলিক
জাতপাত সম্প্রদায়ভিত্তিক সমীকরণও। কিন্তু সে রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই।
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় |
পোস্টারে লেখা হচ্ছে: I am Modified. নরেন্দ্র মোদীর নামে এখন ইন্ডিয়া অধিবাসী যুবকযুবতীদের এমনই ‘ধুম লেগেছে হৃদ্কমলে’ যে, কমল ও ‘হিন্দুত্ব’র যুগলবন্দি নয়, ‘মোদীত্ব’ই অগ্রসরমান। এই মোদীত্ব অবশ্যই এক নতুন ফরমান জারি করছে, যার সঙ্গে গত শতকের আশি-নব্বই দশকের হিন্দুত্বের রাজনীতির ফারাক আছে। সরাসরি কোনও ধর্মীয় আবেগ নয়, মন্দির-মসজিদ নয়, মুখে শুধু উন্নয়ন, কংগ্রেসের অপশাসন, দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্র। কিন্তু এই একই বক্তব্য নিয়ে যদি, ধরা যাক, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করা হত, তবে এতটা আলোড়ন সৃষ্ট হত না। কারণ অতি সহজবোধ্য। সাদামাটা কাজের মানুষ শিবরাজ সিংহ এমনিতেই যথেষ্ট লো-প্রোফাইল। তা ছাড়া, তিনি যে রাজনৈতিক সমাজ নির্মাণ করছেন, তা বাজপেয়ী ঘরানার নরমপন্থী রূপ। উগ্র হিন্দুত্বের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
অপরপক্ষে, মোদী যতই ধর্মীয় পরিচয়-ভিত্তিক প্রসঙ্গগুলি এড়িয়ে যান বা সর্দার পটেলকে নিয়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করুন, তিনিই কার্যত ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’। সিঁদুর লাগানোর দরকার নেই, ওটা সবাই জানে। এই জানাটা যত সুপ্ত ভাবে সুদূরপ্রসারী হয়, ততই পল্লবিত হয় নেতার গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু ওই সুপ্তি একান্ত ভাবে প্রয়োজনীয়, কারণ কোথাও ধর্ম থাকলেও কোথাও জিরাফ বিলকুল আছে। |
অ-বিস্মরণীয়। |
|
|
মুলায়ম সিংহ যাদব। |
মায়াবতী। |
|
যে তিন রাজ্যে বিজেপির জয় হল, সেগুলিতে লোকসভা আসনের প্রায় ৮০ শতাংশও যদি বিজেপি লাভ করে, তবুও বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বড় সাফল্য তার পক্ষে খুব জরুরি, এবং সেই দুই রাজ্যে তার লড়াই কঠিন হতে চলেছে। বিহারে ২৭ অক্টোবরের ‘হুঙ্কার র্যালি’র পর পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, গয়া, মোতিহারি ও মুজফ্ফরপুরের মধ্যে কমপক্ষে যে-কোনও তিনটি জায়গায় জানুয়ারিতে জনসভা করতে চলেছেন মোদী। অন্তত বিহার বিজেপি নেতৃত্ব তেমনটাই চাইছেন। তাঁরা আরও চাইছেন, এই সমাবেশগুলি ছাপিয়ে নালন্দায় মহাসমাবেশ হোক ফেব্রুয়ারিতে। আর ‘হুঙ্কার’ নয়, এ বার শুধুই ‘নমো ধুন’।
সুশীল মোদী, গিরিরাজ সিংহ বা সি পি ঠাকুরের মতো বিহার বিজেপির শীর্ষ নেতারা খুব ভাল করেই জানেন যে, আর জে ডি, এল জে পি এবং কংগ্রেসের মিলিত শক্তির প্রেক্ষিতে একা লড়ে দলের ভোট বাড়াতে বার বার নানা ভাবে মোদীর সাহায্য প্রয়োজন। এমনিতে জয়প্রকাশ নারায়ণের শিষ্যরা পারস্পরিক সখ্যের ভিত্তিতে জনআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম। লালুপ্রসাদ বা নীতীশ কুমারের নিজস্ব চিন্তনের দ্বারা জনসাধারণকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অটুট। লালুপ্রসাদ ও রামবিলাসের সঙ্গে নীতীশ কুমার যদি নির্বাচনী সমঝোতা না-ও করেন, তবু এই দ্বিমুখী শক্তির চাপে বিজেপি হালে কতটা পানি পাবে, তা সন্দেহ আছে। ভোট কাটাকাটির খেলায় নীতীশ কুমার সুবিধা করতে না পারলেও, মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতাপকে অস্বীকার করার কিছু নেই। তাঁর সমস্যা কম নয়, কিন্তু তাঁর ভোট ২০ শতাংশের নীচে নামবে বলে মনে হয় না। |
অ-বিস্মরণীয়। |
|
|
লালুপ্রসাদ। |
নীতীশ কুমার। |
|
অন্য দিকে, ২০১০ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৬.৪৬ শতাংশ। অবশ্যই তা ২৪৩ আসনের মধ্যে ১০২টি আসনে লড়াই করে। সামগ্রিক ভাবে ৪০টি লোকসভা আসনে একা লড়লে বিজেপির ভোট-শতাংশ কিছুটা বাড়লেও তা যথেষ্ট হবে কি? লালুপ্রসাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে কোনও টোল পড়েনি। নিজে লড়তে না-পারাটা তাঁর ব্যর্থতা হবে না, বরঞ্চ শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। সারা রাজ্য জুড়ে তিনি নতুন কোয়ালিশনের জন্য প্রচার ও নিম্নবর্ণ এবং সংখ্যালঘু মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন। সঙ্গে জেল-খাটা সহানুভূতির হাওয়া। নীতীশ কুমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কিন্তু উভয়েরই ঘোষিত শত্রু নরেন্দ্র মোদী। এ ক্ষেত্রে লালুপ্রসাদের নিরন্তরতা অনস্বীকার্য।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকার ফলে লালুপ্রসাদের সাংগঠনিক ভিত্তি কিছুটা দুর্বল হয়েছে। ২০১০-এর বিধানসভায় পেয়েছেন সর্বনিম্ন ১৮.৮৪ শতাংশ ভোট। কিন্তু ২০০৯-এর লোকসভার ভুল তিনি এ বার আর করবেন বলে মনে হয় না। নিম্নবর্ণ, মুসলিম-সহ সামগ্রিক বিজেপি-বিরোধী ভোটের বড় অংশ যদি একত্রিত হয়, তবে সুশীল মোদীদের সমস্যা বাড়বে। একা নীতীশ কুমারও সুবিধা করতে পারবেন না। মোদীর আক্রমণের মূল লক্ষ্য তিনিই। তাই মোদী বিহারে দরিদ্র হিন্দু ও দরিদ্র মুসলিমের প্রতি নীতীশ সরকারের অবহেলা ও তাঁর দরদ বোঝাতে এত ব্যগ্র।
উন্নয়নের থেকে প্রাণের দাম বেশি। বাঁচলে তবে তো ‘রোটি-কাপড়া আউর মকান’। সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট ২২০টি লোকসভা আসনের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। এর মধ্যে ৭৩টি আসন সরাসরি, যার অধিকাংশই রয়েছে অসম, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে। এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে লোকসভা ভোট হলে মোট ১৬২টি আসনের মধ্যে বিজেপি ক’টি পাবে, তা মোটেও পরিষ্কার নয়। হিন্দি বলয়ের প্রধান দু’টি রাজ্য বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মধ্যে দ্বিতীয়টিতেই বিজেপির কিঞ্চিত্ ভাল করার সুযোগ আছে। কিন্তু ২০০৯-এর তুলনায় ২০১২-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সামগ্রিক ভোট কমেছে। মজার বিষয় হল, উত্তরপ্রদেশে ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়েই ১৮ শতাংশ করে ভোট পেলেও কংগ্রেস ২১ ও বিজেপি ১০টি আসন পায়। সমাজবাদী পার্টি ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩টি ও বহুজন সমাজ পার্টি ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ২০টি আসন পায়। আবার, ২০১২-র বিধানসভায় সমাজবাদী পার্টি ২৯.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪০৩টির মধ্যে ২২৪টি আসন দখল করে, অথচ ২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বহুজনসমাজ পার্টি ৮০টি আসন পায়। অর্থাত্, উত্তরপ্রদেশে ভোট বিভাজনের সঙ্গে আসন প্রাপ্তির সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। এ বার উচ্চবর্ণের পর্যাপ্ত ভোট যদি বিজেপির দিকে যায়, তবুও বহুজাত-বিভক্ত সমাজ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কৌশলে বিভিন্ন কেন্দ্রে সমসংখ্যক ভোট দিয়ে সমাজবাদী, বহুজনসমাজবাদী ও কংগ্রেস প্রার্থীদের জেতাতে পারেন, যাকে বলে ট্যাকটিকাল ভোটিং। মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গা ও তজ্জনিত সামাজিক অভিঘাত এবং অখিলেশ যাদবের চূড়ান্ত প্রশাসনিক ব্যর্থতা সংখ্যালঘু জনসাধারণের মধ্যে যে হতাশা তৈরি করেছে, তাকে স্পর্শ করতে চাইছেন রাহুল গাঁধী। বিজেপি রাহুলের এই প্রয়াসকে যতই ‘দাঙ্গা পর্যটন’ বলে উপহাস করুক, বস্তুত নির্বাচনী মেরুকরণ প্রস্তুত। নরেন্দ্র মোদীর আবাহন সেই প্রস্তুতিতে ঘৃতাহুতি দেবে মাত্র। বিরক্তি যেখানে সমাজবাদী প্রশাসনের বিরুদ্ধে, সেখানে বেশি শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির হাতই ধরা হবে। শরণার্থী শিবিরে শিশুদের লাশগুলি তেমনই বার্তা দেয়।
ঘটনা হল, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে এক সময় বিজেপির উত্থানের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল প্রবল কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া এবং তার উপাদানগুলির ক্রমবিভাজন। ক্ষমতার রাজনীতি লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমারকে পৃথক করে ফেলায় শরদ যাদব বা নীতীশ কুমারকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে বিজেপির বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সে ছিল বাজপেয়ীর বিজেপি। বাবরি ধ্বংসের পরও তা সম্ভব হয়েছিল। গোধরা-পরবর্তী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির ওই নেতাদের কাছে সেই গ্রহণযোগ্যতা নেই। লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমার আলাদা হয়েও সাঁড়াশি আক্রমণ হানতে পারেন। চন্দ্রশেখর বা জর্জ ফার্নান্ডেজের মতো উচ্চাভিলাষ যেমন তাঁদের আছে, তেমনই আছে সমাজবাস্তবতার সঙ্গে লিপ্ত থেকে সহজিয়া নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা।
উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রামমন্দির প্রশ্ন। করসেবা, রথযাত্রা প্রভৃতির মাধ্যমে তত্কালীন বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণী যে সমাজবাস্তবতা নির্মাণ করেছিলেন, তাতে জাতপাত নির্বিশেষে হিন্দু-ভোট কিছুটা একত্রিত হতে পেরেছিল। সংঘ পরিবারের নিরন্তর প্রচেষ্টা তাকে শক্তি জুগিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশে দলিত নেতা কল্যাণ সিংহ এক সময়ে কলরাজ মিশ্রদের টপকে যেতে পেরেছিলেন। এ বারের নির্বাচনে সে রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া আছে, নাগরিক উচ্চবর্ণের মোদী-অনুগমন আছে, আবার উচ্চমার্গের আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের জাতপাত সম্প্রদায়ভিত্তিক সমীকরণও আছে। হুঙ্কার আছে। র্যালি আছে। কিন্তু বিজেপির আসন? এবং, কে জানে, ষোড়শ লোকসভায় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশই হয়তো নির্ণায়ক হতে চলেছে। |
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |
|
|
|
|
|