নাবালক ছেলেমেয়ের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে পড়শি দু’টি গ্রামের দুই পরিবারে ঝামেলা। অভিযোগ, সেই ঝামেলা মেটাতে গিয়ে মেয়ের বাড়ির লোকেদের মারে মারাত্মক জখম হন ছেলের বাবা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরে রবিবার গভীর রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় মৃতদেহ রেখে ঘণ্টা দু’য়েক পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। মঙ্গলবার সকালে খয়রাশোলে, বাবুইজোড়-সিউড়ি সড়কের ঘটনা। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত অবরোধ চলার পরে পুলিশের কাছ থেকে দোষীদের গ্রেফতারির আশ্বাস পেয়ে বাসিন্দারা দেহ নিয়ে ফিরে যান।
পুলিশ জানায়, নিহতের নাম উজ্জ্বল মণ্ডল (৪৫)। বাড়ি খয়রাশোলের খরিকাবাদ গ্রামে। জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “নিহতের স্ত্রী একটি খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। ইতিমধ্যে মেয়ের বাবা-সহ দু’জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তদন্ত চলছে।” |
আবরোধে স্তব্ধ যান চলাচল। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, খয়রাশোলের নাকাড়াকোন্দা হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ওই ছাত্রীর সঙ্গে একই স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রের দীর্ঘ দিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক। দুই পরিবারের অবশ্য তাতে সম্মতি ছিল না। যদিও উভয় পরিবারই পরে সম্পর্ক মেনে নেয়। অভিযোগ, মাস ছ’য়েক আগে পুরনো বক্রেশ্বর মন্দিরে দুই নাবালকের অবৈধ ভাবে ‘বিয়ে’ও দিয়ে দেওয়া হয়। মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে অবশ্য শর্ত ছিল, সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে বাপের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। এমনকী, তত দিন দু’জনের মেলামেশাতেও বিধিনিষেধ থাকবে। ওই শর্ত আরোপ নিয়েই মেয়ের বাবা তারকনাথ পালের সঙ্গে উজ্জ্বলবাবুদের বিরোধ বাধে বলে অভিযোগ। ছেলের পরিবারের দাবি, বাবার কথা শুনে মেয়েটিও ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে। মেয়েটির পরিবারের পাল্টা দাবি, প্রেমিকাকে স্কুলেও তার কাছে ঘেঁষতে না দেখে নাবালক ছাত্রটি অসন্তুষ্ট হয়। তার জেরে ছেলেটি মেয়েটির উপরে বিভিন্ন ভাবে অধিকার ফলানোর চেষ্টা করতে শুরু করে। এমনকী, সে মেয়েটিকে উত্ত্যক্তও করে বলে অভিযোগ। গোটা ঘটনায় দুই পরিবারে তিক্ততা আরও বাড়ে।
এলাকার মানুষের দাবি, এই সময় সমাধান সূত্র খুঁজতে উভয় পরিবার স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের দ্বারস্থ হয়। মাস দেড়েক আগে স্থানীয় তৃণমূল নেতা কাঞ্চন দে-র উপস্থিতিতে দু’পক্ষের আলোচনা হয়। কাঞ্চনবাবুর দাবি, “আলোচনার পরে দু’পক্ষই ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের মনোভাব নরম করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারকবাবু অবশ্য সাফ জানিয়ে দেন, মেয়ে সাবালক হওয়ার পরেই তাঁরা মেয়েকে ছেলের বাড়ি পাঠাবেন।” এ সব কিছুর পরে সম্প্রতি দিন দশেক আগে দুই পরিবারে ফের ঝামেলা বাঁধে নাবালিকা মেয়েটির সাইকেল খোয়া যাওয়া নিয়ে। মেয়ের পরিবারের অভিযোগ, বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন স্কুলে এলে ছেলেটি তার সাইকেল কেড়ে নিয়ে চলে যায়। মেয়েটি তা নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে মৌখিক ভাবে অভিযোগও করে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দু’টি পরিবারের নিজস্ব ব্যাপার বলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মিটমাট করে পরামর্শ দেয়।
ছেলেটির পরিবারের দাবি, গত শুক্রবার উজ্জ্বলবাবু নাকাড়াকোন্দায় মেয়েটির সাইকেল ফেরত দিতে এসেছিলেন। দুই পরিবারে একপ্রস্থ আলোচনাও শুরু হয়। কিন্তু আলোচনা তর্কাতর্কিতে পৌঁছয়। নিহতের স্ত্রী মিন্তা মণ্ডলের দাবি, তখনই মেয়ের বাবা তারকনাথ ও তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণাদেবী উজ্জ্বলবাবুকে লাঠি দিয়ে পেটান। এ কাজে তাঁদের সাহায্য করেন কাঞ্চনবাবু। মারাত্মক জখম অবস্থায় উজ্জ্বলবাবুকে প্রথমে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, পরে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে কলকাতার এসএসকেএম হালপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসাধীন থাকার পরে রবিরার গভীর রাতে সেখানেই উজ্জ্বলবাবু মারা যান।
ওই ঘটনায় শনিবারই নিহতের স্ত্রী তিন জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন। নিহতের ভাই বিশ্বরূপ মণ্ডলের দাবি, “পুলিশ শুধু তারকবাবুকেই গ্রেফতার করেছে। অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাকে এখনও গ্রেফতার করেনি। তারই প্রতিবাদে আমরা রাস্তা অবরোধে সামিল হতে বাধ্য হয়েছি।” কাঞ্চনবাবুর অবশ্য দাবি, “ঝামেলা মেটাতে ওই দুই পরিবার আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন ঠিকই। একবার আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু বারবার বিবাদ দেখা দেওয়ায় আমি বিরক্ত হয়ে আর বিষয়টির সঙ্গে জড়াইনি। আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে।” এ দিকে, মন্দিরের ওই বিয়ে বৈধ বলে গণ্য না হলেও প্রশ্ন উঠছে, প্রশাসনের নজর এড়িয়ে পরিবার দু’টি কী ভাবে দুই নাবালকের ‘বিয়ে’ দিল! স্কুল কর্তৃপক্ষই বা ওই দুই নাবালক ছাত্রছাত্রীর এমন ‘বিয়ে’ রোখার ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নিল না-ই বা কেন? খয়রাশোলের বিডিও মহম্মদ ইসরার বলছেন, “ওই অবৈধ বিয়ের কথা আমার কাছে পৌছয়নি। জানতে পারলে অবশ্যই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতাম।” অন্য দিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষকেরও দাবি, “ওই দুই ছাত্রছাত্রীর এমন বিয়ের কথা জানতামই না!” |