নতুন বছর এসে এল। কিন্তু এখনও মুখ ফিরিয়ে পরিযায়ী পাখির দল। এই ছবি কালনার ছাড়িগঙ্গায়।
বিলের জল কচুরিপানায় মুখ ঢাকাতেই পরিযায়ী পাখির দল মুখ ফিরিয়েছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। পাখিদের আবার বিলে ফিরিয়ে আনতে নতুন করে পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে চাইছে প্রশাসন। অন্যান্য বছর শীতের সময়ে পূর্বস্থলী পঞ্চায়েতের চুপি, কাষ্ঠশালী গ্রাম উজিয়ে নদিয়া জেলা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত ছাড়িগঙ্গা বিল ভরে যায় অস্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়া, শ্রীলঙ্কা থেকে আসা পরিযায়ী পাখিতে। কিন্তু এ বছর এখনও সেই ভাবে দেখা নেই তাদের। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বিলের জলে সম্প্রতি কচুরিপানা জমতে শুরু করে। বর্তমানে প্রায় পুরো বিলটাই ভরে গিয়েছে কচুরিপানায়। পরিষ্কার জল না পেয়ে পরিযায়ী পাখিরা আসছে না। হাওড়ার লিলুয়া থেকে এই খালে পাখি দেখতে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ বাগচি। তাঁর আক্ষেপ, “প্রায় গোটা খালটাই কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে। যেটুকু জায়গা ফাঁকা রয়েছে সেখানেও খুব বেশি পরিযায়ী পাখির দেখা পেলাম না।” বিলে পর্যটকদের ঘোরানোর জন্য রয়েছে নৌকার ব্যবস্থা থাকলেও জলে কচুরিপানা ভরে যাওয়ায় কমেছে নৌকার সংখ্যা। |
কাষ্ঠশালী গ্রামের বাসিন্দা নৌকাচালক সাইবুল শেখ জানান, পূর্বস্থলী পঞ্চায়েত থেকে নৌকা চালানোর জন্য কিছুটা কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছে। যেটুকু জায়গা পাওয়া গিয়েছে সেখানেই পর্যটকদের ঘোরানো হচ্ছে। পর্যটকদের নিয়ে ঘোরানোর জন্য প্রায় ২০টি নৌকা থাকলেও তার মধ্যে বেশির ভাগই এ বছর জলে নামেনি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, পর্যটকদের কাছে বিলকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বছর দশেক আগে জেলা পরিষদ থেকে চুপি গ্রামের কাছের ছারিগঙ্গা খালে পাখিরালয় তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। গড়ে তোলা হয় ওয়াচটাওয়ার, পিকনিক স্পট, পর্যটকদের বসার জায়গা। নৌকা ভ্রমণের জন্য বাঁধানো হয় ঘাট। রাত্রিবাসের জন্য বাড়ি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন কোটি টাকা। জেলা প্রশাসনের দাবি, এর পর ২০০৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ওই বিলে শীতকালে প্রায় ৭৩টি প্রজাতির পাখি আসে। এর পর গোটা জেলা তো বটেই, অন্যান্য জেলা থেকেও ছাড়িগঙ্গাতে পরিযায়ী পাখি দেখতে ভিড় বাড়তে শুরু করে। |
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পর্যটকদের অতিরিক্ত হুল্লোড়, মাইক বাজানো, জলে বাঁশ পিটিয়ে মাছ ধরা, চোরাশিকারীদের উত্পাত প্রভৃতি নানা কারণে কয়েক বছরে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। খালে কচুরিপানা ভরে যাওয়াও পাখিদের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ। পাখিরালয়ে অবহেলার ছাপ অন্যত্রও স্পষ্ট। পাখির নাম, বিবরণ-সহ দেওয়া লোহার সাইনবোর্ডগুলিতে অযত্নের ছাপ। ৩৫ ফুট লম্বা ওয়াচটাওয়ারে দর্শকদের বসার জায়গায় দেখা দিয়েছে ফাটল। খাল লাগোয়া রাস্তাটিও বেহাল। নেই পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা। পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে কাজ করা স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার সদস্য সঞ্জয় সিংহের অভিযোগ, “সম্প্রতি ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে স্থানীয় পঞ্চায়েত বিল থেকে কচুরিপানা তোলা হলেও তাঁরা পাখি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়নি। ফলে লাভের লাভ তেমন কিছুই হয়নি।”
তবে, এর মধ্যেও নতুন বছরে আশার কথা, এই বিল ও পাখিরালয়কে নতুন করে সাজাতে সম্প্রতি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় জানান, বছর দুয়েক আগে তত্কালীন পর্যটনমন্ত্রী রচপাল সিংহ এই পাখিরালয় দেখে এর পরিকাঠামো উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। এরপর একটি রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। সম্প্রতি পর্যটন দফতর এই পাখিরালয়ের উন্নয়নে ১ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। পূর্বস্থলী ২ ব্লকের বিডিও মোদাসসার মোল্লা বলেন, “বরাদ্দকৃত টাকার মধ্যে ৪২ লক্ষ টাকা আমাদের কাছে এসে গিয়েছে। সেই টাকায় প্রথমে পাখিরালয়মুখী রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হবে। নতুন তৈরি করা হবে পিকনিক স্পট।” জেলা প্রশাসন থেকেও ধাপে ধাপে অর্থ বরাদ্দ করার আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। কচুরিপানা ঢাকা ছাড়িগঙ্গার ‘মেক ওভার’ কবে হয়, এখন সেটাই দেখার। |