প্রবন্ধ ১...
‘সরকার আমার নয়’ এই বোধ পালটাবে?
মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দিল্লির মানুষ, শুধু দিল্লি কেন, সারা ভারতের মানুষ অবাক হয়ে দেখলেন, দু’বছর আগেও যিনি মানুষের পরিচিত ছিলেন না, অণ্ণা হজারের আন্দোলনের জন্মসূত্রে যাঁর জনজীবনে পদার্পণ, অণ্ণার সঙ্গে মতবিরোধের মধ্য দিয়ে যিনি নতুন একটি দল তৈরি করলেন, যাঁকে অবজ্ঞা ও ব্যঙ্গ করে আমাদের ‘জাতীয় জামাই’ তাঁর সমর্থকদের নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যাংগো পিপল’ বা আম মানুষ তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দিল্লির মসনদে! ভারতের অন্য শহরেও যেন কেজরিওয়ালের মিছিলের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিজেপি, কংগ্রেস উভয়েই ধন্দে পড়েছে। বিজেডি দলের জয় পন্ডা-র কিছুটা অবিশ্বাসী টুইটার মেসেজ থেকে মনে হয়, হয়তো বা প্রাদেশিক দলগুলিও একটু নড়েচড়ে বসবেন। রাজনীতির এই রকম একটি আকস্মিক দিক পরিবর্তনের কোনও তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। শ্রীকেজরিওয়াল নিজেও একে ঐশ্বরিক ‘কুদরতি’ বলেছেন। পণ্ডিতেরা দাড়ি নেড়ে বলেছেন, ‘আর কিছু দিন যাক, তবে বোঝা যাবে।’ ব্যক্তিগত ই-মেল সূত্রে জানি, পণ্ডিতানিদের মতও একই রকম।
‘মুক্তি’র দিন। শপথগ্রহণের পরে। রামলীলা ময়দান, দিল্লি, ২৮ ডিসেম্বর। ছবি: রয়টার্স।
তাই, ব্যাখ্যা করার ইচ্ছে থেকে নয় ব্যাখ্যা সময়ে বেরোবে বরং কেজরিওয়ালের মুখ্যমন্ত্রিত্বের এই প্রথম মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও রাজনীতির ছাত্র হিসেবে যে কয়েকটি কথা মনে হল, তারই কিছু লিখি।
প্রথমেই বলি, ইতিহাসে কিছু কিছু মুহূর্ত হয়, যেগুলো মুহূর্ত হিসেবেই জরুরি, সেগুলো যেন রুটিনবাঁধা জীবনের মধ্যে কোনও বিশেষ ও অপ্রত্যাশিত ছুটির দিনের মতো। মানুষ রুটিন ও প্রাত্যহিকতায় ফিরতে বাধ্য হলেও, ওই দিনগুলোর রেশ প্রথম প্রেমে পড়ার স্মৃতির মতো, কখনও ফুরোয় না। পরবর্তী কালের ব্যর্থতা ও জটিলতা আমাদের সাবধানী করে তুলতে পারে, কিন্তু তাতে এই বিশেষ দিনগুলোর ঔজ্জ্বল্য কমে না। ভারতের স্বাধীনতা দিবস এই রকম একটি দিন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষী রাষ্ট্রের পতন ও নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তিলাভও সেই রকম। আমেরিকায় বারাক ওবামার বিজয়ের দিনটিই হয়তো তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বন্ধু আহমেদ কামাল তাঁর পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থে পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবসটির একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় কাতারে কাতারে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউই বাসভাড়া দিচ্ছেন না, মিষ্টান্ন বিতরণ হচ্ছে বিনে পয়সায়। মানুষ পরের দিনও ফিরে এসেছেন একই প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু সে দিন তাঁদের বোঝাতে হয়েছে না, না, কাল ছিল স্পেশাল দিন, রোজ রোজ কি আর স্বাধীনতা দিবস হয়? কামাল তাই বলেছেন, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় স্বাধীনতার রাজনীতি যেন ছিল একটি অনন্ত ঈদের দিনের মতো যেখানে সত্যি ইনসান আর ইনসানে ভাইচারা হয়। ছোট-বড়র ভেদাভেদ ভুলে একটি সর্বমানুষের মিলনক্ষেত্র তৈরি হয়।
আম আদমির ক্ষমতায় আসার সূচনার সময়টিতে যে এ রকম একটি বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হবে, তা আশ্চর্য নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায়, ব্লগে দেখছি, নানান মানুষ কেজরিওয়ালকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখছেন। রাস্তার অবহেলিত মানুষরা, বহিরাগত শ্রমিকরা, আরও অনেকে। প্রশাসক কেজরিওয়াল এই সব দাবি কী ভাবে মেটাবেন, তা পরের কথা। কিন্তু নেতা কেজরিওয়াল এই বিশেষ দিনের ‘মুড’টি ঠিকই ধরেছিলেন, তাই ‘পয়গম’ ছবিতে গীত মান্না দে-র গান নিজেও গাইলেন, অন্যদের গাওয়ালেন: ‘ইনসান কা ইনসান সে হো ভাইচারা’।
কেজরিওয়ালের শপথগ্রহণ উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যেন ভারতীয় ইতিহাসের দু’টি অমোঘ সত্য মিশে আছে। প্রথমত, ভারতবর্ষে যে দিনগুলোতে ‘রাজনীতি’ সাধারণ মানুষের সম্পদ হয়ে ওঠে অর্থাৎ যে দিনগুলো ইউটোপিয়া বা কল্পরাজ্যের সম্ভাবনায় ভরে ওঠে, সেই দিনগুলো যে শুধু উৎসবের দিন হয়, তা-ই নয়, এক ধরনের ‘মুক্তি’র বা স্বাধীনতার দিনও যেন হয়ে ওঠে। নইলে ভাবুন, এখনও গাঁধী-টুপি, সত্যাগ্রহ, অনশন ইত্যাদির ব্যবহার কেন? এ সমস্তেরই উদ্ভাবনা ব্রিটিশ রাজত্বের কালে। একটি ভিনদেশি মানুষ-পরিচালিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক। স্বাধীনতার পর পরই নেহরু, অম্বেডকর দুজনেই বলেছিলেন বহু বার যে, রাষ্ট্র যখন এ বার ভারতবাসী মানুষের, বিদেশির বিরুদ্ধে তৈরি ওই সব সংগ্রামী অস্ত্রের আর কোনও প্রয়োজন নেই। মানুষ শোনেনি সে কথা। বিক্ষোভের মুখে, আন্দোলনের সময় তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক, কায়দাকানুন সব ফিরে আসে। পাঠকের মনে থাকবে, সি পি এমের আমলে গোবিন্দপুর বস্তির আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, বেশি পুলিশি অত্যাচার হলে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ বানিয়ে দেব।’ অণ্ণা হজারে, কেজরিওয়ালরাও তাই গাঁধী-টুপি ছাড়েন না।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে আম আদমি আন্দোলনে এই যে শারীরিক সংগ্রামের প্রতীক বা স্লোগানের ব্যবহার, এতে একটি জিনিস মনে হয়। ভারতীয় সরকার এখনও ভারতবাসীর সরকার পুরোপুরি হয়নি। ভোটের সময়, ক্রিকেট ম্যাচের সময়, ‘দেশ’কে অনুভব করি ঠিকই। কিন্তু দৈনন্দিনের ভাবটি এই যে, সরকার আমার নয়, বাইরের যন্ত্রবিশেষ। সরকারের কাছে পাওয়ার আছে, তাকে দেওয়ার তত নেই। তাই সরকারকে ফাঁকি দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু সরকারি পরিষেবার গাফিলতিতে আমাদের বিক্ষোভ।
আমার বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তা হলে কেজরিওয়ালের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এই: ভ্রষ্টাচারী সরকারের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার সংগ্রামের তিনি নেতা বটেন, কিন্তু এ বার এই নতুন সরকার যে আম আদমিরই সরকার এই বোধ তিনি কী ভাবে তৈরি করবেন? আমাদের দেশে আমজনতার সৎ রাজনীতি এ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাষাতেই নিজেকে প্রকাশ করেছে, কারণ সরকারকে আমরা সাধারণত নিজের বলে ভাবি না। কথায় আছে, ‘কোম্পানি কা মাল, দরিয়া মে ঢাল।’ সরকার যে দিন আর ‘কোম্পানি’ থাকবে না, আম আদমির নিজস্ব হয়ে উঠবে, সে দিন গাঁধী-টুপি, সত্যাগ্রহ ছাড়াই আন্দোলন করা চলবে। নতুবা আম আদমির রাজনীতি মূলত প্রত্যাশার ও ‘মুক্তি’র আন্দোলনের ভাষাতেই আবদ্ধ থাকবে।
দ্বিতীয়ত, আমার খুব তাৎপর্যপূর্ণ লেগেছে ওই সিনেমার গানের ব্যবহার। ‘পয়গম’ ১৯৫৯ সালের ছবি। টিভিতে আবার দেখায়, কেজরিওয়াল হয়তো তখনই দেখেছিলেন। এই আম আদমির ধারণা তৈরি হওয়ায় পঞ্চাশের দশকের হিন্দি ছবির একটি বড় ভূমিকা আছে। রাজ কপূরের একাধিক ছবির আসল নায়ক ‘আম আদমি’। ‘চারশো বিশ’ ছবিটার কথা ভাবুন। ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’, শৈলেন্দ্র রচিত ১৯৫৫ সালের এই গানটিকে আমাদের এককালীন জাতীয় সংগীত বললে ভুল হয় না। এখানেই একটি ছোট ইতিহাস আছে। রাজ কপূরের ওই ছবির সময় ‘আম আদমি’ ছিল নেহরুর সরকারের জাতি গড়ার প্রকল্পের অংশ।
ক্রমে আমাদেরই রাজনীতির ফলে আম আদমি আজ মনে মনে সরকার থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর কাছে সরকার যেন বিদেশি, অমানবিক সরকার। অরবিন্দ কেজরিওয়াল আবার দু’হাত এক করার চেষ্টা করছেন। দেখা যাক মেলে কি না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.