উদার বহুত্ববাদ যদি নিজেকে অপদার্থ প্রমাণ করে চলে, তবে
আমরা সুপারম্যানের আলিঙ্গনেই নিক্ষিপ্ত হব। লিখছেন
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
নীতি, আদর্শ, উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, সেন, ভগবতী, সব ছাপিয়ে বর্ষফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, দ্বিতীয় দফায় মনমোহন সিংহেরা ঠিক করে সরকার চালাতেই পারেননি। দুর্নীতি এবং মূল্যবৃদ্ধি যে দুটি দানব ভোটের বাজারে ইউ পি এ’র রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, প্রশাসনিক অপদার্থতাই তাদের এতখানি দাপটের কারণ। দুর্নীতি এ দেশের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু একের পর এক বিরাট বিরাট দুর্নীতি ফাঁস হয়ে চলবে, আর সরকার ন যযৌ ন তস্থৌ! বাজারের আগুন হু হু করে বাড়বে, অথচ সরকারি কর্তারা কতকগুলো ঝাপসা আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দেবেন না! সর্বংসহা ভারতমাতার সন্তানদের পক্ষেও এতটা সহ্য করা কঠিন।
এখানেই নরেন্দ্র মোদী কোপটি মারতে চান। এই জন্যই তিনি ‘প্রবল নেতা’র ভাবমূর্তি ফিরি করে বেড়াচ্ছেন। এই কারণেই ‘গুজরাত মডেল’। সে মডেলে ক’আনা সোনা, কতটা খাদ, সে-সব প্রশ্ন গৌণ, আসল কথা হল লোকের মনে এই ধারণাটি গেঁথে দেওয়া যে, গুজরাত মডেল মানে প্রত্যয়ী, সক্ষম শাসনের মডেল। বহু মানুষ এই ধারণা মনস্থ করেছেন। তাঁরা সবাই হয়তো মোদীর রাজনীতির ভক্ত নন, কিন্তু মনমোহন সিংহের দুর্বলতা এবং রাহুল গাঁধীর উদ্ভ্রান্তি উত্তরোত্তর তাঁদের সর্দার পটেলের স্বঘোষিত উত্তরাধিকারীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পটেল সত্যই লৌহমানব ছিলেন কি না, নরেন্দ্রভাই সত্যই তাঁর উত্তরসূরি কি না, সে সব প্রশ্নও এ ময়দানে অপ্রাসঙ্গিক। এটা বিশ্বাস উৎপাদনের খেলা। |
এবং এক যুগ আগের গুজরাতের কাহিনিও যদি তলায় তলায় সবল শাসকের ভাবমূর্তি বেচতে সাহায্য করে, বিস্ময়ের কারণ নেই। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা স্বীকার করেন, গুজরাতে বাড়াবাড়ি হয়েছিল, কিন্তু সে তো অনেক কিছুতেই অনেক বাড়াবাড়ি হয়। তা ছাড়া ‘ওরাও তো বড্ড বাড় বেড়েছিল, ওদের একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল, তাই না?’ যাঁরা মোদীকে কোনও দিনই ক্ষমা করতে পারবেন না, তাঁদের নিয়ে তাঁর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তিনি বাকিদের ঝুলিতে পুরতে চান। এক মনে তারই চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তাঁকে সবচেয়ে সাহায্য করছে ইউ পি এ’র ধারাবাহিক ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার সঙ্গে ইউ পি এ’র নীতি, আদর্শ বা স্লোগানের সম্পর্ক নেই। এটা স্রেফ তাদের অপদার্থতা। কিন্তু দশচক্র বলে কথা, সেখানে এই ধারণা ক্রমশ জোরদার হচ্ছে যে, এই সব উদার সেকুলার জনকল্যাণী ভাল ভাল কথায় কিচ্ছু হবে না, আমাদের এখন সুপারম্যান চাই, মোদী বুলাও। কর্পোরেট ইন্ডিয়া স্বভাবতই দশচক্রের প্রবল শরিক।
তবু হয়তো শিকে ছিঁড়বে না। ফেসবুকের বাইরেও একটা দেশ আছে, অন্তত এখনও আছে। তার ভাঙা রাজনীতি, আঞ্চলিক স্বার্থ, গোষ্ঠী-পরিচয়, গ্রামভারতের স্বতন্ত্র মন ও মস্তিষ্ক, সব মিলিয়ে হয়তো বা নরেন্দ্র মোদী এ-যাত্রা দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা হতে পারবেন না। এ নিছক আশার ছলনা নয়, বাস্তব রাজনীতির সম্ভাবনা।
কিন্তু এই সম্ভাবনা দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় রাজনীতির বহুধাবিভক্ত চরিত্রের উপরেই। নরেন্দ্র মোদী ঠিক এই বাস্তবটিকেই উল্টো দিক থেকে কাজে লাগাতে তৎপর। তাঁর প্রচারের পরতে পরতে একটিই সুর: অস্থিরতা নয়, অনিশ্চয়তা নয়, বেছে নিন স্থিতি ও নিশ্চয়তা, বেছে নিন শক্তসমর্থ প্রশাসন, বেছে নিন লৌহমানব।
নরেন্দ্র মোদী ব্যক্তিমাত্র নন। প্রতীক। বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভারতের চ্যালেঞ্জ এই প্রতীকের মোকাবিলা করা। কিন্তু সে জন্য তাকে সবার আগে কর্মক্ষম হতে হবে। উদার বহুত্ববাদ যদি নিজেকে অপদার্থ প্রমাণ করে চলে, তবে আমরা সুপারম্যানের আলিঙ্গনেই নিক্ষিপ্ত হব। কাল না হোক, পরশু।
এই ক্রান্তিকালে বামপন্থীরা একটা বড় ভূমিকা নিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাও ডুবেছেন, লোকের চোখে বামপন্থাকেও ডুবিয়েছেন। তাঁদের যাহা ২০১৩, তাহা ২০১৪। |