কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সকাল আটটায় বাজবে ফোন। ল্যান্ডলাইনের রিসিভার তুললে কিংবা মোবাইলে ওই কল ধরলে শোনা যাবে“নমস্কার, কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে বলছি। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।” ‘অটো জেনারেটেড’ অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে যাওয়া ওই ফোন সকাল আটটায় যাঁরা ধরতে পারলেন না, তাঁদের ফোন ফের বাজবে এক ঘণ্টা পরে। তখনও যাঁরা ধরলেন না, তাঁদের ঠিকানায় খোঁজ নিতে যাবেন স্থানীয় থানার পুলিশকর্মীরা।
প্রবীণদের নিরাপত্তায় এ বার দৈনিক ওই ‘অটো জেনারেটেড ফোনকল সিস্টেম’ চালু করতে চলেছে কলকাতা পুলিশ। বিএসএনএল ও কয়েকটি বেসরকারি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার সঙ্গে এই ব্যাপারে লালবাজারের কথা চলছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এই ব্যবস্থা শুরু হওয়ার কথা।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, রঙের মিস্ত্রি, কলের মিস্ত্রি, এমনকী, পুরনো পরিচারক-পরিচারিকার হাতেও খুন হয়েছেন একা থাকা বয়স্ক মানুষেরা। সহজেই তাঁরা দুষ্কৃতীদের শিকার হন বলে পুলিশের বক্তব্য। মূলত ওই প্রবীণ মানুষদের কথা ভেবেই ২০০৯-এর ২৭ জুন কলকাতা পুলিশ শুরু করে ‘প্রণাম’। এর সদস্যেরা বিনামূল্যে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা পান, পুলিশি সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই অগ্রিম টাকা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না তাঁদের। তা ছাড়া, সপ্তাহে এক বার ফোন করা ও দু’সপ্তাহে এক বার ‘প্রণাম’-এর সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার কথা স্থানীয় থানার পুলিশের। বর্তমানে ‘প্রণাম’-এর সদস্য সংখ্যা ন’হাজার আটশোর কিছু বেশি।
কিন্তু তার পরেও একা থাকা প্রবীণ মানুষদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে, সে দিকে ইঙ্গিত করে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ গত ২৯ নভেম্বর তাঁর ক্রাইম কনফারেন্সে নির্দেশ দেন, ওই বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ আরও নিবিড় করতে হবে। গত নভেম্বরেই দেশপ্রিয় পার্কের কাছে বিপিন পাল রোডে ক্যানসারে আক্রান্ত অশীতিপর রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়কে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। সেই ঘটনায় বাড়ির সাফাইকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বাড়িতে রঞ্জিতবাবুর একমাত্র সঙ্গী বলতে ছিলেন তাঁর অসুস্থ স্ত্রী। আবার জুলাইয়ে অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা সত্তর ছুঁই-ছুঁই সুলোচনাদেবীকে গলা কেটে খুন করে দুষ্কৃতীরা। তিনি কসবার একটি ফ্ল্যাটে একা থাকতেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সিপি-র নির্দেশের পরেই ‘অটো জেনারেটেড ফোনকল’ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দেয় কলকাতা পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (৩) দেবাশিস রায় বলেন, “আমরা কয়েকটি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার সঙ্গে কথা বলছি। তাদের প্রস্তাবগুলি বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। অটো জেনারেটেড ফোনকল ‘প্রণাম’-এর সদস্যদের নিরাপত্তা বাড়াবে।”
কিন্তু পুলিশের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই ফোনকল হবে একমুখী। যিনি ফোন ধরবেন, তিনি কিছু জানাতে পারবেন না। কসবার বাসিন্দা, ‘প্রণাম’-এর সদস্য তরুণ ঘোষালের বক্তব্য, “আমরাও যাতে এই ব্যবস্থায় যোগাযোগ করতে পারি, তার উপায় রাখা দরকার। আমাদের কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট সংখ্যার বোতাম টেপার মতো ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ব্যবস্থাটি দ্বিমুখী না হলে লাভ নেই।” তা ছাড়া, ফোন বাজলে একা থাকা প্রবীণদের ঘরে হানা দেওয়া কোনও দুষ্কৃতীও তা ধরতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রবীণ মানুষটি যে বিপন্ন, তা বোঝার উপায় থাকবে না।
লালবাজারের এক অফিসার অবশ্য বলেন, “যে বাড়িতে দুষ্কৃতীরা হানা দেয়, সেই বাড়ির কোনও ফোন বাজলে তারা সাধারণত ভয়ে ধরে না। ফোনকলটি ‘রিসিভ’ করা হয়েছে,
সেটা জানলে আমরা বুঝব, বয়স্ক মানুষটির কাছে কেউ না কেউ আছেন। আর আমাদের কাছে সাহায্যের প্রয়োজন হলে স্থানীয় থানা কিংবা ‘প্রণাম’-এর হেল্পলাইনে ফোন করার সুযোগ তো থাকছেই।”
তবে শহরের একা থাকা বয়স্ক মানুষদের সবাইকে এখনও ‘প্রণাম’-এর সদস্য করতে পারেনি কলকাতা পুলিশ। বিপিন পাল রোডের রঞ্জিতবাবু কিংবা কসবার সুলোচনা দেবী ‘প্রণাম’-এর সদস্য ছিলেন না। সুতরাং, শুধু ‘প্রণাম’-এর সদস্যদের নিরাপত্তা আরও বাড়িয়ে একা থাকা অন্যান্য বয়স্ক মানুষদের উপরে দুষ্কৃতী হামলার আশঙ্কা কতটা কমানো যাবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে পুলিশেরই অন্দরে। অথচ ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ পরিকল্পনা নিয়েছিল, একা থাকা প্রবীণদের নাম ও বিস্তারিত বিবরণ থানা এলাকা ধরে ধরে নথিভুক্ত করা হবে। সেই কাজ অবশ্য এখনও হয়নি। |