শুধু পার্ক স্ট্রিট নয়, বর্ষবরণের উৎসবে নজরদারির পরিসর এ বার কিছুটা বড় করছে কলকাতা পুলিশ। নিরাপত্তা বাড়ছে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। পাশাপাশি, বর্ষশেষের রাতে সল্টলেক, নিউ টাউন, লেকটাউন, ভিআইপি রোড এলাকাতেও সুরক্ষা-বলয় করতে চলেছে বিধাননগর কমিশনারেট।
গত কয়েক বছর ধরে বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিটকে কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে রাখত লালবাজার। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের আশপাশের এলাকাগুলি অনেকটা অরক্ষিত থাকত। ফলে ওই এলাকাগুলিতে নানা ঘটনা ঘটত বলে পুলিশ সূত্রের খবর। এ বছর সেই প্রথায় কিছুটা বদল আনতে চলেছেন লালবাজারের কর্তারা। যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র বলেন, “এ বার পার্ক স্ট্রিট ছাড়াও রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড, ক্যামাক স্ট্রিট, শেক্সপিয়র সরণিতে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।” তিনি জানিয়েছেন, শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বাহিনী মোতায়েন থাকবে। আগে রাত দু’টোয় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হত। এ বার তা ভোর ছ’টা পর্যন্ত থাকবে।
লালবাজারের এক কর্তা জানান, গত কয়েক বছরে দেখা গিয়েছে, বর্ষবরণের রাতে পার্ক স্ট্রিটে তেমন বড় অপরাধ ঘটেনি। কিন্তু ইএম বাইপাস-সহ শহরের নানা প্রান্তে ইভটিজিং, শ্লীলতাহানি কিংবা মারামারির মতো ঘটনা ঘটেছে। সে সব মাথায় রেখেই উৎসবের রাতে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে ওই কর্তার দাবি। তিনি জানান, মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে শ’দেড়েক প্রশিক্ষণরত মহিলা পুলিশকেও নিয়ে আসা হচ্ছে। |
পানশালা-হোটেলগুলিতেও বাড়ানো হচ্ছে নিরাপত্তার বহর। পুলিশ সূত্রের খবর, বর্ষবরণের রাতে অনেকেই মত্ত অবস্থায় পানশালাগুলিতে গোলমাল বাধান। তা ছাড়া, ইদানীং শহরে উঠেছে বাউন্সারদের বাড়াবাড়ির বিতর্কও। চলতি মাসেই দমদমের এক পানশালায় বাউন্সারদের মারে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে গোলমাল ছড়ায়। বর্ষবরণের রাতে সেগুলিও মাথায় রাখছে কলকাতা পুলিশ। বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রেও জানা গিয়েছে, পানশালার ভিতরে থাকবে সাদা পোশাকের পুলিশ। বাইরে থাকছে ক্যামেরাওয়ালা গাড়ি থেকে সিসিটিভি-র নজরদারি। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “পানশালা-হোটেলদের নিয়ে বৈঠকে এ সব নিয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। থাকবে সাদা পোশাকের পুলিশও।”
অতীতে বর্ষবরণের রাতে সল্টলেক স্টেডিয়ামের কাছে এক যুবকের ছুরিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা, ভিআইপি রোড ও সল্টলেকের পানশালাগুলিতে বিক্ষিপ্ত নানা ঘটনা, উপরন্তু বেপরোয়া মোটরবাইক বাহিনীর তাণ্ডবের কথা ভেবে এক দিকে যান নিয়ন্ত্রণ, অন্য দিকে আইনশৃঙ্খলা দুটোতেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিধাননগর কমিশনারেটের এয়ারপোর্ট ডিভিশনের এডিসিপি সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, “পানশালার বাইরে থাকবে ক্যামেরার নজরদারি। গাড়ি পার্কিং নিয়েও বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে।”
এর পাশাপাশি, জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণের কথা মাথায় রেখে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে থাকছে বম্ব স্কোয়াডের সতর্ক নজরদারিও।
বিগত বছরগুলিতে দেখা গিয়েছে, বিধাননগর কমিশনারেট এলাকায় বিশেষত সল্টলেক ও নিউ টাউনে যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং। অভিযোগ উঠেছিল, গাড়ি পরীক্ষার তেমন ব্যবস্থা থাকছে না। সম্প্রতি জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণের পরে গাড়ি পরীক্ষার বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়েছে পুলিশকর্তাদের।
এক পুলিশকর্তা বলেন, “বম্ব স্কোয়াডের একটি দল এ বার এয়ারপোর্টে ও অন্য একটি দল সল্টলেক ডিভিশনে থাকবে। প্রয়োজন মতো তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে।” সূত্রের খবর, বিধাননগর কমিশনারেটের ৯টি থানা এলাকার বিভিন্ন প্রবেশপথে গাড়ি পরীক্ষা করবেন পুলিশকর্মীরা। ভিআইপি রোড, রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ে, নিউ টাউন ও সল্টলেকের ভিতরেও টহলদারি জোরদার করা হবে।
গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইকো পার্কে একগুচ্ছ প্রকল্প উদ্বোধন করার পর থেকেই পাল্লা দিয়ে আট থেকে আশি সকলেরই ভিড় বেড়েছে সেখানে। নজরদারি জোরদার করতে এ বার ওই পার্কের সামনে নজরদারি টাওয়ার করা হবে। অন্য দিকে, সল্টলেকের নিকো পার্কে কাউবয়দের কারনামা দেখতে আর বরফ বল নিয়ে ছোড়াছুড়ি করতে কয়েক দিন ধরে উপচে পড়েছে ভিড়। এ ছাড়া শপিং মল, সিনেমা হল এবং নানা ধরনের মেলার ভিড় তো লেগে রয়েছেই। সব দিক মাথায় রেখেই বর্ষবরণের রাতে বিধাননগর কমিশনারেট এই বিশেষ পরিকল্পনা।
বিধাননগর কমিশনারেট সূত্রের খবর, বর্ষবরণের রাতে সাধারণ ভাবে দেখা যায়, রাত বাড়লে সর্বত্র হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। গাড়িও যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে সমস্যা হয় নজরদারিতেই। এ বার সেই ভিড়কে এক জায়গায় আনতে চাইছে পুলিশ। সেই কারণে সল্টলেক, পাঁচ নম্বর সেক্টর, নিউ টাউনের জনবহুল জায়গাগুলিতে ‘ফ্রি-ভেহিকল্স স্পেস’ থাকবে।
নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করতে কলকাতা পুলিশ আর কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? রাজীব মিশ্র জানান, গোটা শহরে পাঁচ হাজারেরও বেশি পুলিশ থাকবে। রাতে ১৩টি অতিরিক্ত রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড ও ৩টি হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড থাকবে। পার্ক স্ট্রিট এলাকায় ১৫টি পুলিশ সহায়তা বুথ থাকবে। রয়েছে ৪টি নজরদারি টাওয়ার-ও। রাতে উড়ুক্কু যান (আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকল) দিয়েও নজরদারি চালানো হবে। এ ছাড়াও, মোটরবাইকে টহল দিতে বলা হয়েছে পুলিশকর্মীদের।
গত কয়েক বছরে মোটরবাইক বাহিনীর দাপাদাপি ঘুম কেড়েছে বিধাননগর কমিশনারেটেরও। সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি আটকাতে মোটরবাইকের উপরে নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে। রাতভর কন্ট্রোল রুম, ১০০ ডায়াল সক্রিয় রাখার পাশাপাশি পুলিশের উচ্চ-কর্তারা রাস্তায় থাকবেন।
সল্টলেক ডিভিশনের এডিসিপি অজয় প্রসাদ বলেন, “রাতভর নজরদারি চলবে। প্রবেশপথে নজরদারি, গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় কড়া টহলদারি যেমন থাকবে, তেমনই জনবহুল জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হবে।”
কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পিকেট বসানোর জন্য বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনারদের বলা হয়েছে। ডিউটিতে থাকবেন উচ্চ-কর্তারাও। কন্ট্রোল রুমেও অতিরিক্ত বাহিনী থাকছে। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “মহিলাদের জন্য বিশেষ হেল্পলাইন (৮০১৭১০০১০০) রয়েছে। রাতে কোনও বিপদে পড়লে সেখানেও জানানো যাবে।” |