চিরাচরিত ধারা থেকে খানিকটা সরে এসে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার পথ বাতলালেন কলকাতার এক দল চিকিৎসক-গবেষক। তাঁদের বক্তব্য, রুটিন কেমোথেরাপি আর নয়। টিউমার টিস্যু সংগ্রহ করে প্রথমে গবেষণাগারে তা কালচার করা দরকার। তার পরে সেই টিস্যুর উপরে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে কোনটি বেশি কার্যকরী, তা বুঝে নিয়ে তবেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। তা না হলে রোগ ফিরে আসতে পারে।
কলকাতার এক ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক-গবেষকদের ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সায়েন্স জার্নাল ‘এক্সপেরিমেন্টার সেল রিসার্চ’-এ। সেল বায়োলজি ও মলিকিউলার বায়োলজি সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে ওই পত্রিকাটি আন্তর্জাতিক স্তরেই স্বীকৃত।
কী রয়েছে ওই গবেষণাপত্রে? চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী এক দল স্তন ক্যানসার রোগিণীর উপরে তাঁরা সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ৮০ শতাংশের কেমোথেরাপির পরে বছর খানেকের মধ্যে রোগটা আবার ফিরে এসেছে। কখনও স্তনে, কখনও আবার অন্য কোনও অঙ্গে। পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা যায়, তাঁদের সকলেরই জিনের নানা ধরনের বিবর্তন ঘটেছে। ঘটে গিয়েছে নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন। তার জেরেই কেমোথেরাপি তাঁদের কাজে আসেনি। চিকিৎসকেরা এর জন্য ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জিন’কে দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, ওই জিনের কারণেই ক্যানসার
কোষের মাইক্রো এনভায়রনমেন্ট-এর পরিবর্তন ঘটে।
মধ্য কলকাতার এক ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়, গবেষক সুদেষ্ণা গঙ্গোপাধ্যায় এবং অর্ঘ্য নন্দী এই গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছেন। আশিসবাবুর কথায়, “সময় এসে গিয়েছে আলাদা করে প্রত্যেক রোগিণীর জিন পরীক্ষা এবং ড্রাগ সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করে তার পরে কেমোথেরাপি ঠিক করা। তা না হলে এই রোগের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। গোটা বিশ্ব এখন এই পথেই হাঁটার কথা ভাবছে।”
স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে জিন পরীক্ষা মানেই অনেকে ধরে নেন বিআরসিএ-১ এবং বিআরসিএ-২ পরীক্ষা, যার মাধ্যমে অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ক্যানসারের আগাম আঁচ পেয়ে ম্যাসেকটমি করিয়েছিলেন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে ওই পরীক্ষা কোনও কাজে আসবে না। কারণ পরিবারে কারও ক্যানসার থাকলে জিনের ওই পরীক্ষা করে তার আগাম আঁচ মিলতে পারে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে ওই দু’টি পরীক্ষায় বিশেষ কিছু জানা সম্ভব নয়।
তা হলে কী করা দরকার? আশিসবাবু বলেন, “স্তনের টিস্যু নিয়ে তার উপরে আলাদা আলাদা ভাবে ওষুধ প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সাধারণ কেমোথেরাপির ওষুধ, জৈব উপাদান যেগুলি জিনকে ব্লক করে সেগুলি এবং এরই পাশাপাশি হলুদ বা আদার মতো কিছু প্রাকৃতিক উপাদান যাতে ক্যানসাররোধী গুণ আছে, সেগুলি আলাদা ভাবে প্রয়োগ করে দেখতে হবে। যেটির প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেটিই চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা দরকার।”
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর শুধু এ রাজ্যেই ১৫ থেকে ২০ হাজার মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে রোগটা ফিরে আসছে। সেই কারণে রোগের ফিরে আসা ঠেকানোই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন ক্যানসার চিকিৎসকেরা। গোটা বিশ্ব জুড়েই এ নিয়ে গবেষণা চলছে। চিকিৎসক রোজিনা আহমেদ বলেন, “আমাদের দেশে রোগিণীদের মধ্যে একটা বড় অংশ এত দেরিতে আসেন যে, অনেকের ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরেও পুরোপুরি সেরে ওঠা সম্ভব হয় না। রোগটা ফেরত আসার ভয় থেকেই যায়। চিকিৎসা শুরুর আগে রোগের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হলে চিকিৎসার সুফল অনেক বেশি পাওয়া সম্ভব।” ক্যানসার চিকিৎসক তাপ্তী সেনের কথায়, “এখন স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা হল ‘টেলর মেড’। রোগের ধরনটা যাচাই করে তার পরে চিকিৎসা প্রক্রিয়া স্থির হয়। এ জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রয়োজন।” ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, যে কোনও রোগিণীর জন্যই এক ধাঁচের চিকিৎসা প্রক্রিয়ার দিন আর নেই। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “কোন ওষুধ বেশি কার্যকরী হচ্ছে, আগে তা দেখে নেওয়ার বিষয়টা খুবই ভাল। কিন্তু ব্যবহারিক স্তরে প্রয়োগ করলে তার খরচ কত পড়বে, উপযুক্ত পরিকাঠামো-সহ ল্যাবরেটরি সব ক্ষেত্রে নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে কি না, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে।” |