কুয়াশায় থমকাল রেল-বিমান, দূষণকেও দুষছেন বিজ্ঞানীরা
কুয়াশার পাতলা চাদর নয়, একেবারে আলখাল্লা! যার জেরে রবিবার কলকাতায় পুরোদস্তুর ছন্নছাড়া হয়ে পড়ল বিমান চলাচল। ব্যাহত হল রেলও। দমদমে এ দিন ভোর থেকেই বিমান ওঠানামা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে সমস্ত ট্রেনই কমবেশি দেরিতে চলেছে। চিন্তা বাড়িয়ে আবহবিদেরা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, আজ, সোমবারেও কুয়াশা থাকবে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা উপকূলে দেখা দিয়েছে একটি উচ্চচাপ। মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বরের আগে তার দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে বাতাসের জলীয় বাষ্প আরও জমাট হয়ে কুয়াশা বাড়াবে। এবং এই পূর্বাভাস মিলে গেলে বর্ষশেষের দিনে ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে পড়বে না।
ইংরেজি নববর্ষ উষ্ণ হওয়ার চেয়ে অবশ্য কুয়াশাটাই বেশি ভাবাচ্ছে আবহবিদ ও পরিবেশবিদদের। তাঁদের একাংশের সন্দেহ, কলকাতার কুয়াশার প্রকৃতিই পাল্টে গিয়েছে। আর এর জন্য দায়ী দূষণ। মহানগরীর বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। কুয়াশার সঙ্গে সেই ধূলিকণা মিশে তৈরি হওয়া ‘ধোঁয়াশা’ আলখাল্লার মতো ঢেকে ফেলছে শহরকে। যা সব চেয়ে বেশি থাবা বসাচ্ছে বিমান ও রেল চলাচলে।
কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, রবিবার ভোর সাড়ে ৩টে থেকেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় বিমানবন্দর এলাকা। কলকাতায় যে ইন্সট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) রয়েছে, তাতে বিমান নামার জন্য ন্যূনতম ৩৫০ মিটার দৃশ্যমানতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভোর ৪টের পর থেকে দৃশ্যমানতা ৫০ মিটারে নেমে যায়। ফলে, প্রায় চার ঘণ্টার জন্য উড়ান থমকে যায়। তার পর সারা দিন ধরে প্রতিটি বিমানসংস্থার উড়ানই কমবেশি দেরিতে ছেড়েছে।
বিমানবন্দরের এক অফিসার জানান, এ দিন কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের বিমান ছাড়ার কথা ছিল ভোর ৫টা নাগাদ। ৮টা নাগাদ দৃশ্যমানতা একটু বাড়লে প্রথমে সেই বিমানটি ছাড়ে। ব্যাঙ্কক থেকে কলকাতায় এসে নামে জেট-এর বিমান। ওই সময়টায় কিছুটা স্বাভাবিক হয় বিমান চলাচল। বাংলাদেশের রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি বিমান সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রামে নামতে না পেরে রাত পৌনে ৩টে নাগাদ নেমে এসেছিল কলকাতায়। দৃশ্যমানতা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আটকে ছিল সেই বিমানটিও।
গোলযোগটা সব চেয়ে চোখে পড়ার মতো ছিল কলকাতা-বাগডোগরা রুটে। কুয়াশার জন্য শনিবারের পর রবিবারেও বাগডোগরার উড়ান বাতিল করতে হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়াকে। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, রবিবার সকালে কুয়াশা কিছুটা কমার পর বাগডোগরা গিয়েছিল জেট ও ইন্ডিগোর বিমান। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান ছাড়ার এক ঘণ্টা আগে জানা যায়, বাগডোগরায় আবার কুয়াশা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় আর ঝুঁকি নিতে চায়নি বিমানসংস্থা। বিমানটি বাতিল হওয়ায় যে যাত্রীদের বাগডোগরা থেকে কলকাতায় আসার কথা ছিল, তাঁরা বাগডোগরা বিমানবন্দরে বিক্ষোভ দেখান। আবার, কলকাতা থেকে উড়ে গিয়ে আগরতলায় নামতে না পেরে ফিরে আসে এয়ার ইন্ডিয়ার আরও একটি উড়ান। রাত পর্যন্ত বিমানবন্দরে আটকে থেকে মেজাজ হারান যাত্রীদের অনেকেই।
তুলনায় কম হলেও কুয়াশা ভুগিয়েছে রেলকেও। হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে লোকাল ও দূরপাল্লার ট্রেনগুলি সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক করে দেরিতে চলেছে। উত্তর ভারতের কুয়াশার জেরে এমনিতেই গত কয়েক দিন ধরে হাওড়ামুখী সমস্ত দূরপাল্লার ট্রেন তিন-চার ঘণ্টা করে দেরিতে চলছিল। রবিবার অবশ্য দিল্লি থেকে আসা ট্রেনগুলি গড়ে দু-তিন ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছয়।
এই অবস্থায় পরিবেশবিদদের একাংশের মধ্যে চর্চা শুরু হয়েছে রেল-বিমান যোগাযোগ বিপর্যস্ত করে দেওয়া কুখ্যাত উত্তর ভারতের কুয়াশার মতোই কি ক্রমশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পূর্ব ভারত তথা কলকাতার কুয়াশা? বেশ কয়েক বছর ধরে বিষয়টি নজর করেছেন বিজ্ঞানীদের অনেকে। তাঁদের মতে, দিল্লির মতো উত্তর ভারতের শহরগুলিতে দূষণ অত্যধিক হওয়ার কারণেই সেখানে জমাট ধোঁয়াশা তৈরি হয়। কলকাতাতেও ইদানীং যেন একই ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু)-র রিপোর্ট বলছে, কলকাতার বাতাসে ধূলিকণা মাত্রাতিরিক্ত। তার ফলে হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার বাড়তে পারে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, এ দিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বসানো বায়ু দূষণ মাপার যন্ত্রে ভোর ৪টে থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ স্বাভাবিকের দ্বিগুণ ছিল।
কেন এই অবস্থা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের শিক্ষক পুনর্বসু চৌধুরী বলছেন, “কলকাতায় বায়ু দূষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নির্মাণস্থল থেকে ছড়িয়ে পড়া ধুলো। এর ফলেই নানা সমস্যা হচ্ছে।” বস্তুত, বাগুইআটি এলাকার একাধিক বাসিন্দার বক্তব্য, ভিআইপি রোডে উড়ালপুলের নির্মাণস্থলে ধুলোর দাপটে রাস্তা চলাচলই দায় হয়ে উঠেছে। এ হেন বিভিন্ন নির্মাণস্থলের পাশাপাশি যত্রতত্র ভাঙা রাস্তাও ধুলো ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া আছে কলকারখানার ধোঁয়া। শহরে গাড়ি বাড়ছে, গাড়ির ধোঁয়াও বাড়ছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “শীতকালে বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ঘন কুয়াশা তৈরি হচ্ছে। যেখানে গাছ বেশি, সেখানে এই দূষণ কম। ঘন কুয়াশাও কম।”
পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা উপকূলের যে উচ্চচাপটি কুয়াশা তৈরি করছে, তার ঠেলায় শীতও থমকে গিয়েছে বলে জানিয়েছে হাওয়া অফিস।
বড়দিনের আগেই এক বার উচ্চচাপের ধাক্কায় থমকেছিল শীত। বড়দিনে কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে ২ ডিগ্রি বেশি। বছরের শেষ দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বড়দিনের মতোই থাকতে পারে বলে হাওয়া অফিসের খবর। এ দিনই কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে পারদ কিছুটা চড়েছে। কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের তুলনায় ১ ডিগ্রি বেশি।
তা হলে কি নতুন বছরের শুরুতেও শীতের দাপট মিলবে না?
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ আশ্বাস দিচ্ছেন, মঙ্গলবার রাত থেকেই উচ্চচাপটি দুর্বল হতে শুরু করবে। তার জেরে নতুন বছরের শুরুতেই শীত ফিরতে পারে দক্ষিণবঙ্গে। আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, উত্তর ভারতে কনকনে শীত পড়েছে। উচ্চচাপের বাধা সরে গেলে ওই ঠান্ডা বয়ে আসতে পারে। আবহাওয়া দফতরের এক বিজ্ঞানী জানান, একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা পূর্ব ভারতের দিকে বয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি এ রাজ্যে পৌঁছলে শীত জোরালো হতে পারে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.