মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসন সংস্কারে ঠিক পথটি বাছিয়াছেন। অগ্রসর হইবেন কি? সাফল্যের পুরস্কার এবং ব্যর্থতার শাস্তি বিধান করিয়া মুখ্যমন্ত্রী অচলায়তনে নাড়া দিয়াছেন। অচলায়তনটির মেদ কমাইতে তত্পর হইবেন কি? মন্ত্রিসভা কর্মক্ষম হউক, ইহাই যদি তাঁহার লক্ষ্য হয়, তবে অনিবার্য প্রশ্ন: এত মন্ত্রী কেন? আইন মোতাবেক মন্ত্রিসভার আয়তন যত দূর অবধি বাড়ানো সম্ভব, পশ্চিমবঙ্গে উহা তত দূর অবধি বাড়ানো হইয়াছে। মন্ত্রিত্বকে পারিতোষিক হিসাবে দেখিবার ধারাটি বামফ্রন্ট জমানাতেই প্রবল হইয়াছিল। ফলে মন্ত্রকের সংখ্যাও যথেচ্ছ বাড়ানো হইয়াছে। দমকল হইতে শুরু করিয়া প্রাণিসম্পদ বিকাশ, সব বিষয়েই মন্ত্রীর প্রয়োজন হইয়াছে। শিক্ষাকে এতগুলি ভাগে ভাঙিয়া এত জন শিক্ষামন্ত্রী বসানো হইয়াছে যে আশঙ্কা ছিল, বুঝি-বা প্রত্যেক শ্রেণির জন্য এক জন মন্ত্রীর আবশ্যক হইবে। যতগুলি দফতর তৈয়ারি করা যায়, পারিতোষিকের রাজনীতি ততগুলি দফতর তৈয়ারি করিয়া লয়। কিন্তু মেদবাহুল্য স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ব্যয়বাহুল্য তাহার একটি কারণ। যত মন্ত্রী, যত দফতর, তত ব্যয়, অমিত মিত্রের তত সমস্যা। কিন্তু আরও বড় সমস্যা কর্মকুশলতার। মন্ত্রী, আমলা, থাকবন্দি কর্মিবাহিনী, ফাইলের স্তূপ যে কাজ এক দিনে হয়, তাহা আঠারো মাস অবধি গড়াইয়া দিবার অব্যর্থ বন্দোবস্ত। মুখ্যমন্ত্রী যদি কাজের গতি বাড়াইতে চাহেন, মন্ত্রী কমান।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার মন্ত্রিসভার তালিকাটি এক বার মন দিয়া পড়িলেই দেখিবেন, বহু দফতরের কোনও প্রয়োজন নাই। আগাছা চিনিতে আতসকাচ লাগিবে না, কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। অন্তত একটি ক্ষেত্রে, শিক্ষায়, তিনি শুরুতেই মন্ত্রীর সংখ্যা কমাইয়াছেন। অন্যান্য বিষয়েও এই নিয়ন্ত্রণ জরুরি। মূল নীতিটি স্পষ্ট। যে সব ক্ষেত্রে সরকারি নীতির বড় ভূমিকা আছে এবং/অথবা সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে মন্ত্রকের প্রয়োজন, অন্যত্র নয়। যেমন স্বরাষ্ট্র বা অর্থ মন্ত্রক স্বতঃসিদ্ধ। শিক্ষার মতো বিষয়ে এ দেশে সরকারের একটি ভূমিকা থাকে, সুতরাং মন্ত্রী আবশ্যক, কিন্তু তাঁহার ভূমিকাও নীতি রচনার, বাকি সমস্ত কাজ যথাসম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে ছাড়িয়া দেওয়াই বিধেয়। কিন্তু দমকলের জন্য মন্ত্রী লাগিবে কেন, তাহার উত্তর ব্রহ্মাও জানেন বলিয়া মনে হয় না। আদর্শ অবস্থায় শিল্প মন্ত্রকেরও কোনও প্রয়োজন থাকিবার কথা নয়, শিল্প বাজারের নিয়মেই হওয়া বিধেয়। কিন্তু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ আদর্শ অবস্থা হইতে অনেক দূরে, সুতরাং শিল্পায়নের স্বার্থেই হয়তো শিল্প মন্ত্রকের প্রয়োজন।
কিন্তু শিল্পের বিভিন্ন এলাকার জন্য আলাদা আলাদা মন্ত্রকের প্রয়োজন কী? বৃহত্ শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পের মন্ত্রী-বিভাজনের যুক্তি কী? তথ্য প্রযুক্তির জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রীই বা কেন দরকার? বস্তুত, কেন্দ্র বা রাজ্য, যে কোনও স্তরেই তথ্য প্রযুক্তির জন্য মন্ত্রক তৈয়ারি করিবার রীতিটিই বলিয়া দেয়, এ দেশের সরকারি ব্যবস্থাপনায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রভাব কী বিপুল। এই শিল্প বাজারের টানে গড়িয়া উঠিয়াছে, বাজারের নিয়মেই প্রসারিত হইতেছে। সূচনাপর্বে সরকার হস্তক্ষেপ করে নাই, বস্তুত বুঝিতেই পারে নাই, সেই কারণেই এই শিল্প স্বাভাবিক স্ফূর্তি পাইয়াছে। পরবর্তী অধ্যায়ে মন্ত্রক বানাইয়া ‘তথ্য প্রযুক্তি নীতি’ রচনার আড়ম্বর অনেক হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে শিল্পের কী লাভ হইয়াছে বলা কঠিন। ‘আই টি পার্ক’ ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণে সরকার কেন নাক গলাইবে? এই ধরনের বিশেষ পরিকাঠামোই বা কতটা আবশ্যক? কিন্তু সে সকল প্রশ্ন মুলতুবি রাখিলেও মূল রহস্য থাকিয়াই যায়: তথ্য প্রযুক্তির জন্য আস্ত এক জন মন্ত্রীর কী প্রয়োজন? মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিতে পারেন। |