বৃদ্ধা মাকে নিয়ে যাদবপুর থেকে তারাতলা যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন সন্দীপ সামন্ত। যাদবপুরে ৮বি অটোস্ট্যান্ডে এক চালক ঘোষণা করে দিলেন, ভাড়া লাগবে ১৭ টাকা। সন্দীপ জানতেন, মাসখানেক আগে ওই রুটে অটোর ভাড়া ১২ থেকে বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে। তার উপরে আবার বৃদ্ধি! সে-কথা তুলতেই অটোচালকের উত্তর, “যেতে হলে চলুন। না-হলে অন্য রাস্তা দেখুন।” ফেরার পথে আরও ঝামেলা। তারাতলার অটোচালকেরা যাদবপুর ৮বি-র ভাড়া হাঁকলেন ২০ টাকা। সন্দীপ মাকে নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করলেন কিছু ক্ষণ। কিন্তু বাস কোথায়? অটোয় ২০ টাকা কবুল করেই তাঁদের ফিরতে হল যাদবপুরে।
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম মেনে জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহণের ভাড়া বাড়ে বলেই পরিবহণ শিল্পে জড়িতদের অভিমত। কিন্তু রাজ্য সরকার বাসভাড়া বাড়াতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, বাসভাড়া বাড়লে সাধারণ মানুষের উপরে খরচের বোঝা বাড়বে। অথচ অটোর ভাড়া বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রশ্ন উঠছে, সরকারের কি অটোর রাশ টানার দায় নেই? সরাসরি জবাব দিচ্ছে না কেউ। তবে অটোয় যে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই, সন্দীপদের মতো নাকাল নিত্যযাত্রীদের অভিজ্ঞতা তারই প্রমাণ। ইচ্ছেমতো রুট তৈরি করে চলা (কাটা রুট), যথেচ্ছ ভাড়া আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আছে অটোর দৌরাত্ম্যও। |
অটো এমন বে-লাগাম কেন?
দফায় দফায় দাম বাড়ছে জ্বালানির। বাড়ছে যন্ত্রাংশের দাম। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া না-বাড়ায় সঙ্কটে পড়েছেন বাস-মালিকেরা। দিনের পর দিন ক্ষতি সামাল দিতে না-পেরে অনেক মালিকই বাস বসিয়ে দিচ্ছেন। ফলে কলকাতা ও লাগোয়া এলাকায় বেসরকারি বাস-মিনিবাস কমছে প্রায় প্রতিদিনই। এই অবস্থায় অটোই নিত্যযাত্রীদের ভরসা। সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন অটোচালকেরা। বাস না-পেয়ে যাত্রীরা অটো ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। অটো তিন থেকে চার-পাঁচ গুণ পর্যন্ত ভাড়া হাঁকছে। বাসে যাদবপুর থেকে তারাতলা পর্যন্ত ভাড়া ৭-৮ টাকা। কিন্তু বাস না-থাকায় যাত্রীরা বাধ্য হয়ে অটো নিচ্ছেন এবং সুযোগ বুঝে কোপ মারছেন অটোচালকেরা। কখনও নিচ্ছেন ১৫ টাকা। কখনও ১৭ কিংবা ২০ টাকাও।
মর্জিমতো ভাড়া হাঁকার সঙ্গে সঙ্গে আছে অটোর কাটা রুটের সমস্যা। কাটা রুট মানে সরকার নির্ধারিত রুট না-মেনে অটো নিয়ে ইচ্ছেমতো ঘোরা। এবং যাত্রীদের তাগিদ দেখে ঝোপ বুঝে কোপ মারা। যেমন রুবির মোড়-হাজরা রুটের কিছু অটোচালক যাচ্ছেন গড়িয়াহাট পর্যন্ত। অন্য দল গড়িয়াহাট থেকে হাজরা পর্যন্ত যাচ্ছেন। তারাতলা থেকে যাদবপুর ৮বি পর্যন্ত একটানা অটো প্রায় আসেই না। তার বদলে মর্জিমতো আসে আনোয়ার শাহ রোড বা সাউথ সিটি পর্যন্ত। একটানা রুট এ ভাবে ভেঙে দেওয়ায় অনেক সময়েই যাত্রীদের দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হচ্ছে।
কলকাতার দক্ষিণ থেকে উত্তর অটো-ভাড়া যথেচ্ছ বাড়ানো হচ্ছে সর্বত্রই। বেশির ভাগ জায়গায় দু’তিন মাসের মধ্যে অটোর ভাড়া এক টাকা করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও এই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে দু’টাকা থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত।
অটোয় লাগাম দিতে সরকার উদ্যোগী হচ্ছে না কেন?
অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে ২০১২ সালের এপ্রিলে অটো কমিটি গড়া হয়েছিল। তারা ওই বছরেরই জুনে সরকারকে রিপোর্ট দিয়ে বলে, শহর জুড়ে অটোর ভাড়া একই রকম হওয়া উচিত। কমিটির পরামর্শ ছিল, প্রথম তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া হোক পাঁচ টাকা। তার পরে দু’টাকা করে বাড়ুক প্রতি দু’কিলোমিটারে। কিন্তু সরকার সেই রিপোর্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশই করেনি। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র তার পরে একাধিক বার ঘোষণা করেছেন, কাটা রুটে অটো চালানো যাবে না। অটোর ভাড়া ইচ্ছেমতো বাড়ানো যাবে না। বাড়ালে সরকার ব্যবস্থা নেবে ইত্যাদি। কিন্তু মন্ত্রীর ঘোষণাই সার। গত এক বছরে অন্তত আট বার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাসের ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু অটোর ভাড়া বেড়েছে অন্তত দু’বার। তারও উপরে আছে অটোচালকদের মর্জিমাফিক ভাড়ার জুলুম।
কী বলছে বিভিন্ন অটো ইউনিয়ন?
শাসক দল তৃণমূলের অটো ইউনিয়নের অধিকাংশ নেতা সরাসরি ভাড়া বাড়ানোর কথা স্বীকারই করছেন না। যাঁরা করছেন, তাঁদের যুক্তি, গ্যাসের দাম বাড়ায় ভাড়া বেড়েছে। আর বিরোধী দল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু অটোর ভাড়া ইচ্ছেমতো বাড়ানোর দায় চাপাচ্ছে তৃণমূলের শ্রমিক ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি-র উপরে। এক সিটু নেতা বলেন, “গ্যাসের দাম বেড়েছে, এই অজুহাতে বিভিন্ন রুটে গত দু’মাসে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি ঠিক নয়। অটোর ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে শুধু সরকারই। তাই সরকারের অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
“আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। অটোর ভাড়া সরকারই ঠিক করবে,” আশ্বাস দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। কিন্তু কবে সরকার ব্যবস্থা নেবে, তার সদুত্তর দিতে পারছেন না রাজ্যের তাবড় তাবড় পরিবহণকর্তাও।
এই অবস্থায় বাস-মালিকদের প্রশ্ন, জ্বালানির দাম বাড়লে অটোর ভাড়া যদি বাড়ানো যায়, বাসের ভাড়া বাড়বে না কেন?
নবান্নের খবর, বাসভাড়া নিয়ে আজ, সোমবার বৈঠকে বসছে পরিবহণ সংক্রান্ত মন্ত্রিগোষ্ঠী। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটসের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সরকার বাসের ভাড়া বাড়াবে না, অথচ অটোর ভাড়া ইচ্ছেমতো বাড়বে এটা চলতে পারে না। আমরা মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। সেখানে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত না-হলে ৩১ জানুয়ারি আমরা একতরফা ভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে দেব। নইলে এ রাজ্যে পরিবহণ শিল্পই মুখ থুবড়ে পড়বে।” |