|
|
|
|
অপর্ণা যখন তন্বী |
তিনি হয়ে যাচ্ছিলেন পৃথুলা।
অথচ মাত্র কয়েক মাসেই এখন তন্বী। পাঁচ কেজিরও বেশি
ওজন কমানো, নতুন মেকওভার সম্পন্ন অপর্ণা সেন-য়ের কাছে রহস্য জানতে চাইলেন ইন্দ্রনীল রায়। |
বছরের একদম শেষ বেলায় কলকাতা শহরকে চমকে দিয়েছেন তিনি।
এমনিতে যেখানেই তিনি যান, সেখানেই তিনি ‘হেডটার্নার’।
কিন্তু গত দেড় মাসে একটা অন্য কারণে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অপর্ণা সেন।
এক ঝটকায় কমিয়ে ফেলেছেন পাঁচ কেজি ওজন। কিন্তু তার জন্য নিজেকে কোনও ভাবে ভাত খাওয়া বা মিষ্টি খাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখেননি। করেননি কোনও ক্র্যাশ ডায়েট। হাঁটেননি ট্রেডমিলে।
তা হলে কী করে করলেন এমনটা অপর্ণা সেন? কেনই বা করলেন?
বাঙালি মেয়েরা কোন ডায়েটে কী ভুল করেন তার সবটাই জানালেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। |
মোটিভেশনটাই আসল |
“আমি অনেক দিন পর একটা ছবিতে অভিনয় করতে চলেছি। ছবির নাম ‘চতুষ্কোণ।’ সেখানে আমি একজন পরিচালকের ভূমিকায়। ওই ছবির ডিরেক্টর সৃজিত একদিন বলল, “রিনাদি ইউ নিড টু লুজ ওয়েট।” ওর কথা শুনে আমি ওকে বলি, এটা ডিরেক্টরের চরিত্র। কী দরকার বলো তো রোগা হওয়ার? কিন্তু সৃজিত ছাড়ার পাত্র নয়। বলল, “না রিনাদি, আমাদের একজন অ্যাট্রাকটিভ ডিরেক্টর দরকার।” তখন ভাবলাম যখন আমি একজন প্রফেশনাল অ্যাক্টর, তখন আমার শোনা উচিত ওর কথা। সেটাই আমার মোটিভেশন, সেই থেকেই ভাবলাম রোগা হবই,” প্রায় এক নিশ্বাসে শুক্রবার নিজের অফিসে বসে কথাগুলো বললেন অপর্ণা সেন।
কিন্তু মোটিভেশন ছাড়া কি ওয়েট লস করা সম্ভব নয়? সবার কাছে তো আর ফিল্মের অফার থাকে না?
“তাতে কী? অন্য কোনও মোটিভেশন তো থাকতেই পারে। মোটিভেশন কি একটা লক্ষ্য থাকলে, ইট ইজ অ্যান অ্যাডভানটেজ,” বলেন ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-য়ের পরিচালক।
তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল এই রোগা হওয়ার পেছনে রয়েছে নিউট্রিশনিস্ট রেশমী রায়চৌধুরীর ডায়েট চার্ট।
সেই ডায়েট চার্ট মেনেই এতটা ওয়েট কমিয়েছেন রিনা সেন। |
এপ্রিল ২০১৩ |
ডিসেম্বর ২০১৩ |
|
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
|
আমি সব খাচ্ছি, কিন্তু মেপে |
“আমি জানেন সব খাচ্ছি। কিন্তু মেপে। ছোট ছোট অ্যাডজাস্টমেন্ট। চায়ে চিনি খাচ্ছি, কিন্তু সেটা সুগার ফ্রি। আর যেটা করছি সেটা হল প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর খাচ্ছি,” চা খেতে খেতেই বলেন তিনি।
কিন্তু ওজন যাঁরাই কমান তাঁরা প্রায়শই বলেন এটা, ‘সব খাচ্ছি, কিন্তু ভীষণ মেপে’ এটা কতটা কঠিন?
“দেখুন, ডিসিপ্লিন তো আনতেই হবে। আমি ভীষণ ফুডি। দারুণ ভাল লাগে মিষ্টি খেতে। খাচ্ছিও। কিন্তু তার মাত্রাটা কমিয়ে দিয়েছি। ওটা খুব দরকার,” স্পষ্ট বক্তব্য অপর্ণার।
তিনি জানালেন আমেরিকাতে গিয়ে এ বার ফ্যাট ফ্রি স্যালাডের ওপরেই ছিলেন। “ওখানে একটা দারুণ জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। প্লাস্টিকের প্যাকেটে এগ হোয়াইটস। কেন যে এখানে পাওয়া যায় না? কত মানুষের সুবিধা হয় তা হলে,” প্রশ্ন তাঁর।
তা কী কী খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত, যখন ওয়েট লসের প্ল্যান করেছেন আপনি? |
সিঁড়ি তো ভাঙছি,
হাঁটুর ক্ষতিটা ভাবছি না |
“প্রথমেই বন্ধ করতে হবে ডাল খাওয়াটা। পোস্তটাও বাদ দিতে হবে,” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন।
বহু বছর ধরে বাঙালি মেয়েদের ফুড হ্যাবিট দেখে তাঁর একটা কমপ্লেনই তৈরি হয়েছে তাঁদের নিয়ে।
“বাঙালি মেয়েরা না বড্ড এই আলু পোস্ত, ডাল খেতে ভালবাসে। আমিও বাঙালি মেয়ে, আমিও ওই ক্যাটাগরিতেই পড়ি। কিন্তু আজকে বুঝেছি ওগুলো খেলে আর ওজন কমানো যাবে না।”
বাঙালি মেয়েদের প্রতি মৃদু ভর্ৎসনার পাশাপাশি এটাও বলেন, এই ওজন কমাতে তিনি একদিনও জিমে যাননি। বন্ধু বানাননি ট্রেড মিলকে। কিন্তু কেন?
“আমাদের পরিবারের সব মেয়েরই অস্টিওপোরোসিস রয়েছে। আমাদের হাড় ভীষণ উইক। তাই আমার পক্ষে জিমে যাওয়া সম্ভব নয়,” বলেন অপর্ণা। নিজেই জানালেন মুম্বইয়ের ডাক্তার অনন্ত জোশীর কথায় তাঁকে বেশি হাঁটতেও বারণ করা হয়েছে।
“আমরা বাঙালিরা অনেক ভুল করি। আমরা ভাবি হাঁটলে হয়তো রোগা হব। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে হয়তো তাড়াতাড়ি ওজন কমবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে হাড়ের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সেটা আমরা ভাবি না। আমার তো সিঁড়ি ভাঙাও বারণ। মর্নিংওয়াক করতে পারতাম যদি ঘাসের ওপর হাঁটার সুযোগ হত। কলকাতা শহরে আর সে রকম জায়গা ক’টা আছে বলুন? তাই যদি ওজন কমাতেই হয় তা হলে খাওয়া কন্ট্রোলটাই আমার একমাত্র উপায় ছিল। এবং আমি সেটাই করেছি,” সোজাসাপটা বলেন অপর্ণা সেন।
|
রিনা-টিপস |
• একজনের ডায়েট চার্ট অন্য জনকে স্যুট নাও করতে পারে। তাই নিজের খাদ্যাভ্যাস জানিয়ে, কী ওষুধ খান জানিয়ে ডায়েট চার্ট বানান
• খান সব কিছু। কিন্তু দু’ঘণ্টা ইন্টারভ্যালে আর কম পরিমাণে
• শরীরকে কষ্ট দিয়ে, না খেয়ে রোগা হওয়াটা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
• একটা মোটিভেটিং ফ্যাক্টর সামনে রেখে ওজন কমান।
• ডাল আর পোস্ত একেবারে ছোঁবেন না
• হাঁটুর সমস্যা থাকলে কি হাড় দুর্বল থাকলে একদম হাঁটবেন না বা ট্রেডমিল করবেন না। যে যাই বলুক না কেন, ওয়েট লস-য়ের থেকে বেশি ক্ষতি হবে
আপনার হাঁটুর
• পারলে রাত সাড়ে ন’টার
মধ্যে খেয়ে নিন
• রাতে দু’শট স্কচ খেতেই পারেন। স্কিন ভাল হবেই যদি এক্সারসাইজ আর ডায়েট করেন
• ড্রিঙ্কসের সঙ্গে একদম বাদাম জাতীয় খাবার খাবেন না
• স্কিন-য়ের সমস্যা হলে বিউটিশিয়ানের কাছে না গিয়ে ডার্মাটোলজিস্টের কাছে যান
• উপায় থাকলে দুপুরে একটা পাওয়ার ন্যাপ নিন। এতে শরীর এবং স্কিন দুই’ই ভাল থাকবে |
|
সন্ধেবেলা দু’টো স্কচ
তো ঠিক আছে |
ট্রেডমিলে না হাঁটার কারণ তো বোঝা গেল, কিন্তু এটা ভাববেন না যে, কোনও এক্সারসাইজ করেন না তিনি।
নিজেই বললেন যে সকালে উঠে টিভি-তে নিউজ চালিয়ে তিনি অ্যাবস্ করেন, স্ট্রেচ করেন, শুয়ে শুয়ে সাইক্লিং করেন, কিছু যোগাসনও করেন। প্রায় ৪০ মিনিট এটা করেন অপর্ণা।
কিন্তু এখন তো ইয়ারএন্ড। চার দিকে নানা পার্টি, পরের মাস থেকে আবার বিয়েবাড়ি শুরু হবে।
এমন সময় ডায়েট মেনটেন করা কতটা কঠিন?
“দেখুন, পার্টি মানে যদি ড্রিঙ্কস-য়ের কথা বলেন, তা হলে বলি আমি নিজে স্কচ ভালবাসি। টু শটস অব স্কচ কিন্তু ভাল শরীরের পক্ষে। তবে সেটার সঙ্গে বাদামটা অ্যাভয়েড করুন। নাটস্ একদম নয়,” খোলাখুলি বলেন অপর্ণা।
এবং তাঁর কথা অনুযায়ী বিয়েবাড়িতেও কম খাওয়ারই চেষ্টা করেন তিনি।
“বিয়েবাড়িতেও খাই সবই, কিন্তু অল্প পরিমাণে,” উত্তর তাঁর। |
খুব মোটা হয়ে যাচ্ছি,
তাই ভাল লাগে না |
এই যে দু’ঘণ্টার ইন্টারভ্যালে খাওয়া শুরু করেছেন, তার পিছনে রয়েছে মেয়ে কঙ্কনা সেনশর্মার ইনফ্লুয়েন্সও। কঙ্কনা নাকি বেশ কিছু দিন ধরে এই ছোট ছোট মিল খাচ্ছেন। “ও সাঙ্ঘাতিক রোগা হয়ে গিয়েছে। এবং এটা হয়েছে ছোট ছোট মিল খায় বলেই। ও অবশ্য পাওয়ার ইয়োগাও করে।”
৫ কেজি ওজন কমিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েও নিজেই বললেন, তিনি একেবারেই ফিটনেস ফ্রিক নন।
“না না, আমি একদম ফিটনেস ফ্রিক-টিক নই। সারা দিন এক্সারসাইজ করব, ও সব আমার ভাল লাগে না বাবা। কিন্তু খুব মোটা লাগছে আমায় এই ফিলিংটাও আমার ভাল লাগে না। তা থেকেই যতটা করা,” বক্তব্য তাঁর। |
বিউটিশিয়ান নন, ডার্মাটোলজিস্টের কাছে যাই |
৫ কেজি কমানো ছাড়া তিনি মনে করেন আরও একটা দিকে চেঞ্জ এসেছে তাঁর মধ্যে। তাঁর স্কিন অনেক ইমপ্রুভ করে গিয়েছে এই ডায়েট আর এক্সারসাইজের পরে। “আমার মেজো বোনের স্কিন অসাধারণ। আমার সব সময় স্কিন
ভাল ছিল, থ্যাঙ্কস টু মাই জিনস।
কিন্তু এখন এক্সারসাইজ শেষ হওয়ার একটু পর থেকেই স্কিনটা গ্লো করছে। আর এই ডায়েটে লেস অয়েল
রয়েছে। তাই স্কিন এমনিতেই ফ্রেশ থাকে,” বলেন তিনি।
এবং এখানেও বাঙালি মেয়েদের জন্য স্পেশাল টিপস্ রয়েছে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’-য়ের পরিচালকের।
তাঁর মতে বাঙালি মেয়ে বড্ড বেশি ফেশিয়াল করে। “আমি বহু বছর ফেশিয়াল করি না। আমার মনে হয় স্কিন ঠিক রাখতে বিউটিশিয়ানের কাছে না গিয়ে যাওয়া উচিত ডার্মাটোলজিস্টের কাছে। ওঁরাই স্কিনটা বেশি ভাল বোঝেন। আমি তো তাই করি,” চশমাটা মাথায় তুলে বলেন অপর্ণা। |
ভ্যানিটি আছে, কিন্তু সেই রকম ভ্যানিটি নেই |
এ ছাড়া আরও একটা নতুন জিনিসও শুরু করেছেন তিনি। তা হল দুপুরে ঘুম পেলে চট করে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া।
“আমি তো আমার অফিসে কাউচ রেখেছি। দুপুরে ঘুম পেলেই আমি অন্তত আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই। এতে আমার শরীর ভাল থাকছে, স্কিন ভাল থাকছে,” আইফোন দেখতে দেখতে বলেন তিনি।
কিন্তু সবার তো আপনার মতো অফিসে ঘুমোনোর উপায় থাকে না। তাঁদের কী হবে? “হ্যাঁ, জানি সেটা। কিন্তু আমি বলছি যদি কোনও সুযোগ থাকে, যদি দুপুরে একটু হলেও ঘুমোতে পারে মেয়েরা, তাদের শরীর এবং স্কিন দু’টোই ভাল থাকবে,” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন অপর্ণা।
৫ কেজি ওজন তো কমিয়েছেন। ভবিষ্যতে কি তাঁকে আরও স্লিম ট্রিম হিসেবে দেখা যাবে?
“দেখুন, অত ভাবিনি। আমি খাব সব, অনেক বয়স হয়েছে। এই বয়সে ডায়াবেটিস নেই, কোলেস্টেরল নেই, হাই ব্লাড প্রেশার নেই। থ্যাঙ্ক গড। বাকি জীবনটা এমন ভাবে চললেই আমি খুশি। আমার ভ্যানিটি আছে, কিন্তু সেই রকম ভ্যানিটি নেই,” হাসতে হাসতে বলেন ‘নতুন’ অপর্ণা। |
নতুন
ডায়েট চার্ট |
ঘুম থেকে উঠে
এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট |
ব্রেকফাস্ট
একটা এগ হোয়াইটের সঙ্গে দু’টো
টোস্ট
(সপ্তাহে ৪ দিন)
সিরিয়াল আর
আধ কাপ দই
(সপ্তাহে তিন দিন)
৬ পিস মুসম্বি অথবা পেঁপে |
লাঞ্চ
১-২টো হোল গ্রেন-য়ের রুটি
মাঝেমধ্যে
৩০-৪০ গ্রাম
ভাত
ভেজিটেবল স্ট্যু
১ টুকরো
সেদ্ধ মাছ অথবা
২ পিস চিকেন।
সঙ্গে দই (মাঠা তোলা)
স্যালাড |
টি
এক কাপ চা, সঙ্গে বিস্কুট |
স্ন্যাক্স
মুড়ি, চিঁড়ের মতো তেল ছাড়া স্ন্যাক্স
(ভুজিয়া, বাদাম বা ছোলা চলবে না) |
ডিনার
একটা রুটি বা এক পিস টোস্ট
খুব কম তেলে রান্না করা সব্জি
গ্রেভি ছাড়া ২ পিস চিকেন
স্যালাড
(রান্নার জন্য ১০ মিলি-র বেশি তেল ব্যবহার করা চলবে না)
|
রেশমি রায়চৌধুরী (নিউট্রিশনিস্ট) |
|
|
|
|
|
|