নেতা-মন্ত্রীরা বাড়ি গিয়ে সমবেদনা জানানোয় শুক্রবার কিছুটা হলেও শোক-ক্ষোভ সামলে নিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির বজরাপাড়ার বাসিন্দারা। কিন্তু শনিবার সকালে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিস্ফোরণে জখম মহম্মদ রফিকুলের (১৯) মৃত্যু হতেই ফের বিষাদে ডুবে যায় বজরাপাড়া। বৃহস্পতিবারের বিস্ফোরণে নিহতেরা সকলেই ওই পাড়ার বাসিন্দা। প্রায় সকলের বাড়ির প্রবীণেরাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কারও বাবা দিনরাত কবরের কাছে বসে কাঁদছেন। কারও বাড়িতে রান্নাবান্নাই একরকম বন্ধ হয়ে রয়েছে। বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন এ দিন ওই পাড়ায় গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমি তো সমবেদনা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এটুকু সকলকে আবারও বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সরকার আপনাদের পাশে আছে। এমন নাশকতায় জড়িতদের খুঁজে বার করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।” |
রফিকুলের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জলপাইগুড়িতে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
বিস্ফোরণের রাত থেকেই ফতেমাবিবি ছেলে রফিকুলের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজেই ছিলেন। ভেন্টিলেশনে থাকা রফিকুল সুস্থই রয়েছেন শুনে শনিবার সকালে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু দুপুরে পাড়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ে, রফিকুলের লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছে। দুপুর ৩টে নাগাদ তাঁদের বাড়ির সামনে একটি পুলিশ ভ্যান ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের একটি অ্যাম্বুল্যান্স এসে দাঁড়ায়। অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে ছিল রফিকুলের নিথর দেহ। কান্নায় ভেঙে পড়েন ফতেমাবিবি। অসুস্থ হয়ে পড়েন রফিকুলের দাদা শফিউল। পড়শিরা বাড়ির সামনের রাস্তার দু’দিকে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করে নিহত রফিকুলকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ আলমগির বলেন, “রফিকুল খুবই ভাল ছেলে ছিল। ওর এ ভাবে চলে যাওয়া আমরা মানতে পারিনি। তাই ওর বাড়ির সামনের রাস্তার দু’পাশে প্রতিবেশীরা মিলে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিলাম। ওকে আমরা বলতে চেয়েছিলাম, এখনও তোর সঙ্গে রয়েছি।”
জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ার একটি নার্সিংহোমের অ্যাম্বুল্যান্স চালাতেন রফিকুল। বিস্ফোরণের কিছু আগে তিনি অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে তিন বন্ধু, আর্নেস মহম্মদ, রসিদুল ইসলাম এবং পাপ্পু রহমানকে ধরধরা নদীর উপর কার্লভাটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তিনিও তখন কালভার্টের কিছুটা আগে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড় করিয়ে বন্ধুদের দিকে এগোতে শুরু করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। বিস্ফোরণে ঝলসে যান চার বন্ধুই। আর্নেস, রসিদুল এবং পাপ্পুর ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। রফিকুলকে গুরুতর জখম অবস্থায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে তার অদূরেই গলির শেষ প্রান্তে রফিকুলের বাড়ি। |
শনিবার মৃত্যু হয় জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর-বজরাপাড়ায় বিস্ফোরণে আহত মহম্মদ রফিকুলের।
তাঁর দেহ বজরাপাড়ায় আসার পরে শোকে ভেঙে পড়েন পরিজনেরা।—নিজস্ব চিত্র। |
বজরা পাড়ার একটি গলিতেই চার বন্ধুর বাড়ি। রসিদুলের মৃত্যুর খবর পেয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাঁর মা রত্না বেগম। তিনি জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি। শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে নিহত পাপ্পুর ভাই মহম্মদ আবুকেও। দাদার মৃত্যুর পর থেকেই চুপচাপ হয়ে পড়েছিল আবু। এ দিন তাঁর রক্তচাপ কমে যায়। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন পাপ্পুর মা নাজমা খাতুন। পরিজনেরা জানিয়েছেন বাবা বিশারু মহম্মদও মুখে তুলছেন না কিছুই।
রাস্তার পাশেই একটি মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়েছে নিহতদের। আর্নেসে মহম্মদের বাবা ভ্যানচালক আফজাল হোসেনকে ছেলের কবরের সামনে থেকে সরানো যাচ্ছে না। এক পরিজনের কথায়, “কোনও বাবাই ছেলের মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেন না। উনিও পারছেন না। আমরা কত বোঝাচ্ছি। তবুও উনি একা হলেই কবরের দিকে চলে যাচ্ছেন। শুধুই কাঁদছেন।’’
বজরাপাড়ায় শোকের পরিবেশের মধ্যেই নিহতদের পরিবারকে দেওয়া ত্রাণ নিয়েও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এদিন জেলা প্রশাসনের থেকে নিহতদের পরিবার পিছু ২০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মতো স্থানীয় পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতে চাল পাঠানো হয়। তবে চালের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই চাল নিতে আপত্তি করেন নিহতদের পরিজনেরা। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সেই চাল ফের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্লক অফিসে। ঘটনাটি নিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে এ দিন বিকেলে অবশ্য চাল বদলে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রসনা খাতুন বলেন, “খারাপ মানের চাল বিলি করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। সব চাল ফিরিয়ে দিয়েছি। পরে অন্য চাল বিলি করা হয়।”
সদর মহকুমা শাসক সীমা হালদার বলেন, “ঘটনাটি শুনেছি। প্রথমে আতপ চাল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সকলে সেদ্ধ চাল নিতে চেয়েছিলেন। তাই পরে বদলে দেওয়া হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। তবু ঠিক কী হয়েছিল, খোঁজ নিয়ে দেখছি।” |