জলপাইগুড়িতে বিস্ফোরণের পরে জনসংগঠনকে সামনে রেখে কেএলও-র গতিবিধি রুখতে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকার। এ জন্য কামতাপুর রাজ্যের দাবি নিয়ে যে কোনও আন্দোলনেই কড়া নজরদারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। তাই সম্প্রতি কামতাপুর পিপলস পার্টির (কেপিপি) একাধিক কর্মসূচির অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ কেপিপি নেতৃত্বও।
বস্তুত, কেপিপি (কামতাপুর পিপলস পার্টি) এবং কেএলও (কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন)—উভয়েরই দাবি এক। দু’টি সংগঠনই উত্তরবঙ্গ ও নমনি অসমের চার জেলাকে নিয়ে পৃথক কামতাপুর রাজ্য গঠনের দাবিতে সরব। কেপিপি মিটিং-মিছিল করছে। ভোটেও লড়ছে। নিষিদ্ধ সংগঠন কেএলও অবশ্য গোপন ডেরায় বসে সশস্ত্র লড়াইয়ের পথেই হেঁটে চলেছে। বারেবারেই দু’পক্ষের মধ্যে যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু, কেপিপি বরাবরই দাবি করেছে, তারা হিংসার রাস্তায় চলতে রাজি নয়। কাজেই পুলিশ-প্রশাসনের তরফে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে বলে কেপিপির দাবি।
আপাতদৃষ্টিতে কেপিপি-এর সঙ্গে কেএলও-র সরাসরি কোনও প্রামাণ্য যোগসূত্র এখনও পুলিশ-প্রশাসনের কাছে নেই। কিন্তু, জলপাইগুড়ির বিস্ফোরণ-কাণ্ডের পরে যে ভাবে কেপিপি মিটিং-মিছিল, সমাবেশের জন্য কোমর বেঁধে নামতে চাইছে, তাতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা আড়ালে কেএলও-র হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন। গোয়েন্দাদের অনুমান, একদিকে কেএলও নাশকতা চালিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছে।অন্য দিকে, কেপিপি-র মতো সংগঠনের প্রকাশ্য আন্দোলনেও নিজেদের ‘লিঙ্কম্যানদের’ ঢুকিয়ে সেই চাপ আরও জোরদার করার ছক কষেছে কেএলও। তাই রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনও সতর্ক ভাবে পা ফেলতে চাইছে। সরকারি সূত্রের খবর, সে জন্যই সম্প্রতি মালদহ থেকে ডুয়ার্সের সঙ্কোশ পর্যন্ত সাইকেল মিছিল করার অনুমতিও রাজ্যের তরফে কেপিপি-কে দেওয়া হয়নি। আগামী ৩০ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ির বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের সামনে কেপিপি যে আইন অমান্যের কর্মসূচি নিয়েছে, তা-ও করতে দেওয়া হবে না বলে প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা জানান, যে ভাবে শক্ত হাতে পাহাড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করার ছক ভণ্ডুল করা হয়েছে, সে ভাবেই সমতলেও শান্তি বজায় রেখে উন্নয়ন করতে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর। ওই কর্তার দাবি, “রাজবংশী সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট মানুষ, আমজনতার কাছ থেকেও সরকারের কাছে বার্তা পাঠিয়ে শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার অনুরোধ করা হয়েছে। সমতলের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই সরকার পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে।”
অসম সরকারও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। অসমের ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরির মতে, “আলফা, এনডিএফবি-র সঙ্গে কেএলও-র অস্ত্র লেনদেন ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত যোগাযোগ রয়েছে।” অবশ্য, কেএলও-র সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ কোচের দাবি, “উত্তর-পূর্বের সব বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু, আমাদের নিজস্ব শিবিরে প্রশিক্ষণ হয়। অস্ত্রের জন্যও আমরা কারও উপর নির্ভরশীল নই।”
অবশ্য কেপিপির সভাপতি অতুল রায় অভিযোগ করেন, “আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রতিটি সংগঠনের মিছিল করার অথবা দাবি জানানোর অধিকার রয়েছে, দেশের সংবিধান এই অধিকার দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অন্য দলের ক্ষেত্রে কোনও বাধা না এলেও আমাদের মিছিলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এর প্রতিবাদেই আমরা জলপাইগুড়ির বিভাগীয় কমিশনার দফতর ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন হবে।”
রাজ্যের পক্ষে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য জানান, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের শাসনভার নেওয়ার পরে রাজবংশী সম্প্রদায়ের দাবি মেনে পৃথক অ্যাকাডেমি করেছেন। তাঁর কথায়, “পাহাড়-সমতল, মিলেমিশে থাকবে, এটাই মুখ্যমন্ত্রী চান। সে জন্য পাহাড় থেকে সমতল, সর্বত্র একই ভাবে উন্নয়ন হচ্ছে। এতদিন ধরে কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে যে সব কাজ হয়নি সেটাও হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে কোচবিহারে। আরও কলেজ হচ্ছে। শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। আগামী দিনে উত্তরবঙ্গের চেহারাই পাল্টে যাবে। কাজেই উত্তরবঙ্গকে অশান্ত করে সেই উন্নয়নের গতি রোধ করার চেষ্টা করলে মানুষ. তা মেনে নেবেন না।” |