জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই কেএলও-সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে তৎপর নয়। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাহাড়পুর-বজরাপাড়ায় বোমা বিস্ফোরণের পরে এমনই অভিযোগ তুলছেন মূলস্রোতে ফিরে-আসা কেএলও জঙ্গিদের একাংশ। ফেরার কেএলও জঙ্গি জীবন সিংহের গ্রাম উত্তর হলদিবাড়ির কুমারগ্রামে। শনিবার ওই প্রাক্তন জঙ্গিরা দাবি করেন, কেএলও সদস্যদের সঙ্গে সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে। তাঁদের ক্ষোভ, আলোচনায় রাজ্যের অনাগ্রহের কারণে বহু কেএলও জঙ্গি মূলস্রোতে ফিরে আসছেন না।
প্রায় একই অভিযোগ কেএলও-র সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ কোচেরও। শনিবার কেএলও প্রতিষ্ঠা দিবসের ২০ বছর পূর্তি উৎসবে কৈলাশ কোচ আনন্দবাজারকে ফোনে বলেছেন, “পৃথক কামতাপুর না হওয়া অবধি কেএলও-র সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে।” কেএলও-র সাধারণ সম্পাদকের অবশ্য দাবি, রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতার আসার পরেই কেএলও-র প্রতিষ্ঠাতা জীবন সিংহ শান্তি আলোচনা ও সংঘর্ষবিরতি চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সাড়া মেলেনি বলে কেএলও-র দাবি। কৈলাশ বলেন, “দৌত্য ব্যর্থ হওয়ার পরে আমরা সংগ্রাম ছাড়া কিছু ভাবছি না।”
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেও, কৈলাশ অসম সম্পর্কে খানিকটা নরম। তিনি বলেন, “অসমে কামতাপুরিদের স্বার্থ তা-ও কিছুটা সুরক্ষিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কামতাপুরিদের জন্য রাজ্য কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এখানে আমরা কেবলই অবিচার ও অবহেলার শিকার।”
বৃহস্পতিবার রাতে বোমা বিস্ফোরণের পর কেএলও জঙ্গিদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে। উত্তরবঙ্গে মূলস্রোতে ফিরে-আসা কেএলও জঙ্গিদের একটা বড় অংশের দাবি, সরকারের গাফিলতিতেই এমন নাশকতামূলক কাজ ঘটে চলেছে। “কামতাপুর ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে দার্জিলিং বা অসমের বড়োল্যান্ডের মতো করে কেএলও সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। অথচ উদ্যোগী হচ্ছে না সরকার,” বলেন কুমারগ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ। |
ওই প্রাক্তন জঙ্গিদের অভিযোগ, বারবার আশ্বাস দিয়েও সরকার কেএলও সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। অথচ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে দার্জিলিঙের বিমল গুরুঙ্গ, লেপচা ও অসমের বড়োদের দাবি নিয়ে অনেক বেশী সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, “কেএলও-র আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় বসা মানেই যে আলাদা রাজ্য দেওয়া হল তা তো নয়। তা হলে আলোচনায় সরকার উদ্যোগী হচ্ছে না কেন?”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়মন্ত্রী গৌতম দেব শনিবার বলেন, “পাহাড়ের মতো গোটা উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন নিয়েই আমরা বদ্ধপরিকর। যাঁরা সেই উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামিল হতে চান তাঁদের স্বাগত। কিন্তু, তাতে বাধা দিলে কড়া হাতে তার মোকাবিলা করা হবে।”
ফেরার কেএলও জঙ্গি জীবন সিংহের গ্রাম কুমারগ্রামের উত্তর হলদিবাড়ির বাসিন্দারা জানালেন, জীবন সিংহের মা মতেশ্বরীদেবীর মৃত্যুর পর ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। মাঝেমধ্যে জীবনের বোন সুমিত্রা এসে বাড়িটা দেখে যান। সুমিত্রা ও তাঁর স্বামী ধনঞ্জয়ও জঙ্গি জীবন ছেড়ে মূলস্রোতে ফিরেছেন। টেলিফোনে সুমিত্রা বললেন, “বাড়িটা দেখে এখন কান্না পায়। আমরাও চাই দাদা জঙ্গি জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। কিন্তু সরকার সে রাস্তা তৈরি করছে কোথায়? সরকার শীঘ্রই এ ব্যাপারে আলোচনায় বসুক।”
ঘটনা হল, মূলস্রোতে ফিরে-আসা কেএলও জঙ্গি ও লিঙ্কম্যানদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। ২০০৩-এ ভুটানে সেনা অভিযানের পরে কেএলও-র স্বঘোষিত ‘চিফ’ জীবন সিংহ ছাড়া সংগঠনের সিংহভাগ সদস্যই ধরা পড়েন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক জঙ্গি, লিঙ্কম্যান আত্মসমর্পণও করেন। মূলস্রোতে ফিরতে ইচ্ছুক কেএলও জঙ্গি-লিঙ্কম্যানদের স্বনির্ভর করতে রাষ্ট্রীয় সমবিকাশ যোজনায় অর্থ সাহায্য করার কথাও ঘোষণা করে সরকার। অন্তত ৩৫ জন কেএলও জঙ্গি ও লিঙ্কম্যান জঙ্গল জীবন ছেড়ে মূলস্রোতে ফিরে এসেছেন। তাঁদের কেউ ছোট ব্যবসা, কেউ বা দিনমজুরি করছেন। অনেকে সরকারি সহায়তায় গাড়ি কিনেছেন, ছোট দোকান খুলেছেন। তবে অধিকাংশই কোনও সাহায্য পাননি বলেই অভিযোগ। সুমিত্রার ক্ষোভ, “প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেছি। নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে আমাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।”
তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে আত্মসমর্পণকারী টম অধিকারী-সহ কিছু কেএলও জঙ্গিকে জেল থেকে ছাড়া হয়। সুমিত্রার স্বামী অর্জুন ওরফে ধনঞ্জয় বর্মন বলেন, “এই সরকার ক্ষমতায় এসেই আলোচনার কথা বলেছিল। আমাদের দাবি লিখিত আকারে দিতে বলা হয়। কোচবিহারের জেলাশাসকের মাধ্যমে সে দাবিপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হলেও এখনও আলোচনায় উদ্যোগী হয়নি প্রশাসন।” অনেক ঘুরেও সরকারি সাহায্য না পেয়ে টম জঙ্গি জীবনেই ফিরে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। একদা মূলস্রোতে এসেও মালখান সিংহের মত শীর্ষ জঙ্গিরাও ফের জঙ্গি জীবনে ফিরে গিয়েছেন বলেও অভিযোগ। অন্যরাও ফের জঙ্গি জীবনে ফিরে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন বাসিন্দাদের একাংশ। উত্তর হলদিবাড়ির বাসিন্দা মূলস্রোতে ফেরা জঙ্গি মিল্টন ওরফে মিহির দাসের সংসার চলে সামান্য কয়েক বিঘা জমি চাষ করে। তিনি বললেন, “আলোচনায় বসা হলে সমাধানসূত্র একটা বের হবেই। সেটা আলাদা উন্নয়ন পর্ষদ হতে পারে, অথবা জিটিএ-র ধাঁচে কিছু একটা গড়া যেতে পারে।” তবে সকলেই জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে যাঁরা এখনও সশস্ত্র আন্দোলনে সামিল আছেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবার আগে আলোচনা বসা দরকার। কিন্তু সেটা না করে আগের সরকারের মতো এই সরকারও বিরূপ মন্তব্য করছে বলে ক্ষোভ মূলস্রোতে ফেরা জঙ্গিদের।
এ দিকে, জলপাইগুড়ির ঘটনার পর থেকে গোটা কুমারগ্রামই কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে অসম সীমানা ও ভুটান সীমান্ত এলাকাতেও। শনিবার পুলিশ কুকুর নিয়ে রেলস্টেশন ও জনবহুল এলাকা অসমগামী বাসগুলিতে দিনভর তল্লাশি চালায় পুলিশ। |