|
|
|
|
গুরুত্ব বোঝাতেই নাশকতা কেএলও-র
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
অস্ত্র কেনার টাকা নেই। টাকা চাইলে ব্যবসায়ীরাও আর আগের মতো ভয় পেয়ে দিয়ে দিচ্ছেন না। উল্টে, কখনও কখনও জুটছে মুখঝামটা!
কোনও পুরনো বন্ধু সটান জানিয়ে দিচ্ছে, ফ্যালো কড়ি মাখো তেল! বিনে পয়সায় কিছু মিলবে না!
আবার বন্ধু সংগঠন সাহায্যের আশ্বাস দিলেও সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে নানা শর্ত। যা পালন করতে গেলে টাকা লাগবেই!
সব মিলিয়ে গত বছরখানেক ধরেই বড় করুণ দশা চলছে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-এর। গোয়েন্দাদের অনুমান, সেই দৈন্যদশা কাটিয়ে পুরনো রমরমা ফেরাতেই কেএলও নাশকতার চেনা রাস্তায় ফিরছে। বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ির পাহাড়পুর-বজরাপাড়ায় বিস্ফোরণ সেই সন্দেহটাকেই সত্যি প্রমাণ করল বলে মনে করছেন বহু গোয়েন্দা-কর্তা। তাঁদের বক্তব্য, বৃহস্পতিবারের বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে কেএলও এটা প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা করল যে, চাইলে তাদের সংগঠন এখনও জলপাইগুড়ি-কোচবিহার এবং নমনি অসমের বঙ্গাইগাঁও, ধুবুড়ি, গোয়ালপাড়া, কোকড়াঝাড় এলাকায় বড়সড় হামলা চালাতে পারে।
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা এ দিন জানান, কেএলও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে চিন থেকে অস্ত্র আমদানির পরিকল্পনা করেছিল। মণিপুরের একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের এ নিয়ে কথাও হয়। কিন্তু ওই জঙ্গি সংগঠন কেএলও নেতা জীবন সিংহকে শর্ত দিয়ে বলে, অস্ত্রের ব্যবস্থা হতে পারে। তবে তার আগে উত্তরবঙ্গে হামলা চালাতে হবে। যাতে মণিপুর থেকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী তুলে নিয়ে উত্তরবঙ্গে নিয়ে আসতে বাধ্য হয় সরকার।
কিন্তু এই শর্ত পালন করতে পারেনি কেএলও। ওই গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “কিছু দিন আগে জীবন সিংহের টেলিফোন কথোপকথনের একটি রেকর্ডিং আমাদের হাতে আসে। তার থেকে জানা যায়, কেএলও কম্যান্ডার চিন থেকে অস্ত্র আমদানির ব্যাপারে এক আলফা নেতার কাছে সহায়তা চাইছেন। পাশাপাশি, উত্তরবঙ্গ থেকে নতুন নিয়োগ করা যুবক-যুবতীদের মায়ানমার ও অসমে প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেও পাঠানোর প্রস্তাব দিচ্ছেন।” ওই কর্তা জানান, আশ্চর্যজনক ভাবে আলফা নেতাটি আগাম অর্থ না পেলে এই সাহায্য করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এমনকী, কেএলও জঙ্গিদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের জন্য হোটেলের ধাঁচে দৈনিক হিসেবে টাকা নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল আলফা। তাতে প্রতিদিন শুধু আশ্রয় দিতেই জঙ্গি-পিছু হাজার দুয়েক টাকা চেয়েছিল আলফা। প্রশিক্ষণের ‘রেট’ আলাদা। জীবন সিংহ তখন তাঁকে জানান, এখন আর আগের মতো হুমকি ফোনের মাধ্যমে টাকা তোলা সম্ভব হচ্ছে না। নমনি অসম ও উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীরা টাকা চাইলে দরাদরি করছেন। ওই আলফা নেতা পরামর্শ দেন, নতুন করে হামলার পথে না গেলে মানুষের মধ্যে কেএলও সম্পর্কে ভয় তৈরি হবে না। হামলা হলেই ফের টাকা উঠতে শুরু করবে।
এই কথোপকথনের রেকর্ডিং হাতে আসার পরেই সতর্ক হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও অসম পুলিশ। ডিসেম্বরের গোড়াতেই অসমের ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরী নবান্ন-য় এসে এ রাজ্যের পুলিশ প্রধান জিএমপি রেড্ডির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে যান। কেএলও জঙ্গিরা যে নমনি অসম এবং উত্তরবঙ্গে যে কোনও মূল্যে ফের হামলা চালাতে তৎপর হয়েছে, তা নিয়ে বিশদে আলোচনা হয় সেই বৈঠকে। বিশেষ করে অসমগামী পণ্যবোঝাই ট্রাক লুঠ এবং দু’রাজ্যের সীমানা লাগোয়া এলাকায় বড় ব্যবসায়ীদের অপহরণের আশঙ্কার কথা হয় ওই বৈঠকে।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, অসমের বঙ্গাইগাঁওয়ের দেবেন বর্মন ওরফে বর্মন স্যার, ধুবুড়ির নিত্যানন্দ সরকার ওরফে জামাই, মালদহ ও গোঁসাইগাঁওয়ের কৈলাস রায় ওরফে হিরো নমনি অসম ও উত্তরবঙ্গে হামলার ছক কষছিল। গোয়ালপাড়া এলাকা থেকে তারা ২০ জন নতুন যুবককে নিয়োগ করে মায়ানমারের সিন প্রদেশের হাকা জঙ্গলে প্রশিক্ষণের জন্যও পাঠিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এরা ফিরে এসে হামলা চালাতে পারে। এ দিনের ঘটনায় সেই দলেরই হাত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, ২০১৩-র অক্টোবর মাসে ‘কামতাপুর প্রোটেকশন ফোর্স’ নামে একটি বিশেষ তোলাবাজ বাহিনী তৈরি করেছে কেএলও। যার মাথায় রয়েছে সংগঠনের অর্থসচিব নীলাম্বর রাজবংশী। এই তোলাবাজ বাহিনীই অসম ও পশ্চিমবঙ্গে কেএলও-র নতুন চারটে ব্যাটেলিয়নের ভরণপোষণের দায়িত্ব পেয়েছে। পাহাড়পুরে বিস্ফোরণের পিছনে এই বাহিনীর যোগসূত্র উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “এমন একটি হামলার আশঙ্কা ছিলই। গত এক বছর ধরে ওরা উত্তরবঙ্গে নাশকতার ছক কষছিল। এ বার ওদের ফের নিকেশ করার পালা।” |
|
|
|
|
|