|
|
|
|
|
|
|
সময়, আবারও |
টিম মালি
কানাডা |
তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই আমাকে তোমার ডায়েরিটা দেখিয়েছিলে তুমি।
স্বীকার করছি, একের পর এক ঘটনার ধাক্কায় এখনও খানিকটা বিভ্রান্ত আমি। যে ভাবে দুম করেই ঠিক করে ফেললাম ছেড়ে যাব তোমাকে, তাতে তুমিও নিশ্চয়ই কম কনফিউজ্ড নও। ঠান্ডা মাথায় সে-সব অনেক ভেবে দেখলাম, কিন্তু যে ভাবেই ভাবি না কেন, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর পারছি না ও-সব নিয়ে নাড়াচাড়া করতে। তোমার কাছে এ-সবই খুব ঠুনকো অজুহাত মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আমার মাথায় আর কিছু ঢুকছে না, তাই আমাকে চলে যেতেই হচ্ছে।
তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগেই আমাকে তোমার ডায়েরিটা দেখিয়েছিলে। তখন তোমার লিভিং রুমের কাঠের মেঝেটায় শুয়ে শরীরী খেলায় মেতেছিলাম আমরা। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কী ভাবে সূর্যের আলোটা এসে পড়ছিল, বা টগবগ করে চায়ের জল ফুটছিল কেটলিতে, এখনও মনে আছে। তার পর, খাটের পায়ার পাশেই ছিল আমাদের ছেলেটা, জিজ্ঞেস করল কোথায় গিয়েছ তুমি।
‘জানি না রে’, বললাম ওকে। ‘শিগ্গিরই হয়তো ফিরে আসবে।’
তোমার স্টাডিতে গিয়েছিলাম আজ। ঘরটাকে পুরো গ্যালারি বানিয়ে ফেলেছ দেখলাম। নানান সময়ে যতগুলো রিল আমরা ডেভেলপ করিয়েছিলাম, তার প্রত্যেকটারই প্রথম ছবিটা ঘরের কোথাও না কোথাও আছে, দেখলাম। দেখলাম, প্রতিটা ছবির তারিখই দিব্যি মনে আছে, এমনকী যে ছবিগুলো এখনও তোলা হয়নি, সেগুলোরও। মনে হল এমনটা চলতেই থাকবে। এক গাদা তালগোল পাকানো স্মৃতি, চোখ-ধাঁধানো আবছা আলোয় তার প্রত্যেকটা একটু একটু ঝাপসা। ধাক্কা লেগে পেরেকভর্তি একটা কৌটো মাটিতে পড়ে গেল। সেটা তুলতে যেতেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। সরে এলাম তাই।
তোমার বেসমেন্টে খুব একচোট শরীর-খেলা খেলছিলাম, যখন তুমি স্থান-কাল নিয়ে কিছু কথা বলছিলে। তুমি বললে, ভবিষ্যৎটা অতীতের মতোই পুরোপুরি বাস্তব। তুমি আমায় বলেছিলে, কোনও একটা জায়গায় তুমি এখনও পৌঁছওনি বলে ব্যাপারটা অবাস্তব, এমনটা মোটেই নয়। এই যেমন ধরো, তুমি লন্ডনে থাকলেও বাগদাদটা যেমন দিব্যি বাস্তব, ঠিক তেমনই।
তুমি আরও বলছিলে, ব্যক্তিগত সময়, কোন-আকৃতি আলোকরশ্মি আর ফোল্ডিং স্পেসের কথা, যার মাথামুন্ডু কিছুই আমি বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম তোমার বুক দুটোর নড়াচড়া, আর তোমার নিশ্বাসগুলো কী ভাবে ঠান্ডার মধ্যে কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল, সেটা। তার পর দুজনে এসে পড়লাম একটা ঘূর্ণির মধ্যে, তুমি চেঁচিয়ে উঠলে, বললে, ‘এখন থেকে সব সময় এমনটাই হতে থাকবে!’ বেলুন বিক্রি করছিল একটা লোক, হঠাৎ হাত ফসকাল তার, অপূর্ব রাজকীয়তায় সেগুলো সব ভাসতে থাকল আকাশে। দারুণ লাগছিল। |
|
২ |
তুমি নিজের পরিচয় দেওয়ার পর ডেটিং চলতে থাকল আমাদের। আমি আবারও তোমায় জিজ্ঞেস করলাম, কেন ড্রাইভ-ইন রেস্তরাঁ তোমার এত পছন্দ। তুমি আমাকে বললে, বি-মুভিজ নিয়ে তোমার একটা দুর্বলতা আছে। এমন একটা আন্তরিকতা থাকে ছবিগুলোর মধ্যে, যার জন্য অত ভাল লাগে। বললে, এই ছবিগুলো আমাদের কল্পনাকে যেমন ভাবে উসকে দিতে পারে, বিগ বাজেটের ছবিগুলো তেমনটা কখনওই পারে না। বললে, সব সায়েন্স ফিকশনই— তা সে যতই নিরানন্দ হোক না কেন— আখেরে অন্তত এইটুকু আশা জোগায় যে ভবিষ্যৎ বলে একটা জিনিস আছে।
আমরা একটা বড় অফিসঘরে ছিলাম, তুমি এক দল ব্যবসায়ীকে মেশিনটা সম্বন্ধে বোঝাচ্ছিলে। ওরা সবাই হাসছিল আর মাথা নাড়ছিল। আদৌ যে কিছু বুঝছিল তা নয়। কিন্তু ওই যে, বিশেষজ্ঞরা বলে দিয়েছিলেন, তোমার আইডিয়াটা বেশ প্রমিসিং! আর সর্বোপরি, একটা যুদ্ধ চলছিল তখন। কফিটা জঘন্য লাগছিল, আমি আমার চেয়ারে বসে উসখুস করছিলাম। তোমাকে খুব উজ্জ্বল লাগছিল। মেশিনটা যদি বিগড়োয়, তা হলে যে কী হবে, সেই নিয়ে কোনও প্রশ্ন করার কথা মাথাতেই এল না কারও।
রান্নাঘরের মেঝেতে আজ দেখলাম, একটা ডিম নিজে থেকেই জুড়ছে। খোলার শেষ টুকরোটা জুড়ে যেতেই কট করে অদ্ভুত একটা শব্দ হল, আর অমনি উড়ে গেল সেটা। উড়তে উড়তে কাউন্টারের উপর এসে বসল। মাথার ওপরে তীব্র শব্দে উড়ে গেল একটা হেলিকপ্টার। আমাদের ছেলেটা দৌড়ে এল, বলল খুব ভয় লাগছে ওর। কী যে বলি ওকে, বুঝে পেলাম না। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে, কখন কী ভাবে শেষ হবে তা কে বলতে পারে?
এই চিঠিখানা পড়ে তোমার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, শেষ লাইনটায়, যেখানে লিখেছি, ‘এমন ভাবে তো বাঁচার কথা ছিল না আমাদের’, পড়তেই জল এসেছিল তোমার চোখে। তুমি আমাদের ছেলেটার দিকে ফিরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলে যে আমি চলে গিয়েছি। কিন্তু কী করে বোঝাবে? ওই বয়সের একটা বাচ্চা ‘চলে গিয়েছে’ কথাটার মানে কী-ই বা বুঝবে? তারা-ভরা আকাশের নীচে শুয়ে ছিলাম আমরা। ঠিক যেই প্রথম বাজিটা ফাটল, আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রথম বার তুমি চুমু খেলে আমায়। পপকর্নের মতো লেগেছিল তোমার ঠোঁটের স্বাদ। নতুন এক জন স্বামী বেছে নিয়েছ বলে তোমায় দোষ দিই কী করে বলো?
শেষমেশ যখন ফিরে এলে, বেশ কমবয়সি লাগছিল তোমাকে। এই ব্যাপারটা মেনে নেওয়াই মনে হয় আমাদের দুজনের কাছে সবচেয়ে কঠিন ছিল। এক স্মৃতি ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে আর ছিল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি বলেছিলে, সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি নাকি একটুও বদলাওনি। কথাটা যে ঠিক ছিল না, তা মনে হয় দুজনেই বুঝি এখন। সময় বদলে দেয় সবাইকেই। সেটাই তো রীতি। |
৩ |
বেসমেন্টে গিয়ে মেশিনটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আজ। এখনও মনে পড়ে সে দিনটার কথা, যেদিন প্রথম ওটা চালালে তুমি। ভিড় করে থাকা এক দল খবরের কাগজের লোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি, পাশে আমাদের ছেলে আর তোমার নতুন স্বামী। তুমি সময় আর মৃত্যুর নিষ্ঠুর উৎপীড়ন বিষয়ে ভাষণ দেবে, বিজ্ঞানের জয় নিয়ে বলবে, আমাদের মুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে বলবে। কিন্তু মনে মনে ভাববে, ‘আহা, ও যদি এখানে থাকত এখন, দেখত এ সব!’ আমি এই সব কিছুই জানি, কেননা তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই তো তুমি তোমার এই ডায়েরিটা আমাকে দেখিয়েছিলে, আর এই দিনটার কথা লিখেছিলে সেখানে। আর তা হবে না-ই বা কেন? ওটাই তো ছিল তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। শত্রুর হাত থেকে বাঁচালে আমাদের, যুদ্ধটাও থামালে। তুমি আমাকে বলেছিলে, বন্ধ করো এ সব। কিন্তু আমার যে কিছুই করার নেই। ভবিষ্যৎটা যে অতীতের মতোই, একদম বাস্তব। আগে বা পরে বলে আর কিচ্ছু নেই। কখনও ছিলও না। কারণটা তুমিই।
এমন ভাবে তো বাঁচার কথা ছিল না আমাদের। |
অনুবাদ: নীলাব্জ দাস।
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী। |
|
|
|
|
|