সাক্ষাত্কার ...
উঁকি মারে চটুল সপ্রশ্ন মন

হ্যাঁ, আজকাল বাংলায় বেশির ভাগ লেখালিখি প্রবন্ধের আকারেই, তবে আগে কিছু অন্য রকমের লেখা লিখেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় কয়েকটি লেখা বেরিয়েছিল, যেগুলোকে রম্যরচনা বলা যায়। সাগরময় ঘোষ মাঝে মধ্যেই তাগাদা দিতেন এই ধরনের লেখার জন্য। তবে সে-সব লেখাতেও একটা বড় গুরুতর বক্তব্য থাকত, কিন্তু পত্রিকার পাঠক-পাঠিকাদের কথা ভেবে বিষয়টাকে একটু অন্য ভাবে লিখতাম, যাতে তাঁদের ধৈর্যচ্যুতি না হয়! একটা লেখার নাম ছিল ‘দাসদাসী ও আমরা’। আমাদের দেশে গৃহকর্মে যাঁরা সাহায্য করেন তাঁদের নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা, কিন্তু হালকা গল্পের চালে বেঁধেছিলাম লেখাটাকে। অনেকে সেটা পছন্দও করেননি। রাগত ভাবে জানিয়েছিলেন, বিদেশে থাকি, এই সমস্যায় ভুগতে হয় না বলেই এ ভাবে মজা করে লিখতে পারছি! আর একটা লেখা ‘এ পরবাসে’ ছিল প্রবাসী জীবনের দুই মেরুর টানাপোড়েনের বিশ্লেষণ, কিন্তু গোটা লেখাটার মধ্যে নানা মজার অভিজ্ঞতা, কাহিনি, যার থেকে এই জীবনের সংকটটা বেরিয়ে আসে।
এই বইটির মধ্যেও আগাগোড়া সেই হালকা চটুল চাল। ‘ভূমিকা’-য় বলেছি, আত্মজীবনী না বলে একে রম্যরচনার ধাঁচে মজলিশি গল্প বললেই যথার্থ হয়। নিজের জীবন ফিরে ভাবতে গিয়ে যা যা মনে পড়ে, তার সূত্রে অন্য যে সব অনুষঙ্গ এসে যায়, সেই সব অমনি ভাবেই লিখেছি। কথার পিঠে কথা, গল্পের সূত্রে গল্প। বাঙালি পাঠকের কথা মনে রেখে গল্পচ্ছলে লেখাটাই ভাল বলে মনে হয়েছে।


নিশ্চয়ই। ‘টার্গেট রিডার’-এর ব্যাপারটা সর্বদা মাথায় থেকেছে। পাতা-চল্লিশেক লেখার পর দেখিয়েছিলাম বন্ধু শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে, তিনি উত্‌সাহ দিয়ে বলেছিলেন, যেন এই ধরনটাই রাখি, একেবারে অন্য একটা স্টাইল। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম। দেখবে, একটা ঘটনা বলতে গিয়ে আর একটায় চলে গিয়েছি।


হ্যাঁ, ঠিকই। কখনও সাহিত্যের অনুষঙ্গ, কখনও সম্পূর্ণ অন্য একটা গল্প। হয়তো সেই অন্য গল্পটা বলার মধ্যে একটা রসিকতা আছে। কিন্তু সেটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়নি। আমার মতে, রসকথা একটু পরিমিত ভাবে বললেই ঠিকঠাক শোনায়। বাঙালির অভ্যেস অবশ্য ঠিক উল্টো। উনিশ শতকের লেখক একটা মজার কথা লিখেই লিখতেন ‘সভাস্থ সকলে শুনিয়া হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল’...! রসিকতার ভাষার পরিমিতি একটা অন্য কারণেও জরুরি। বাবার সূত্রে এক জায়গায় বলেছি, মজার কথা কেবল মজা করার জন্যই না-ও হতে পারে। অনেক সময় নিজের বেদনা কিংবা সংবেদনশীলতার ঢাল হিসেবেও রসিকতা করা হয়। বাবা তা-ই করতেন। আমার মধ্যেও সেই প্রবণতা রয়েছে।


অপ্রিয় প্রসঙ্গ ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি। খুব কাছের লোকের কাছ থেকেও বড় আঘাত আসে, এসেছে। কিন্তু না-পাওয়া কিংবা না-হওয়া ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে আমার মন সায় দেয় না। এই ব্যথাগুলো ব্যক্তিগত থাকাই ভাল, সকলের কাছে আড়ালহীন আলোচনার বিষয় করতে চাই না। কী হবে বলো, অনাবশ্যক সর্বজনীন চর্চা ছাড়া? আর সেই জন্যই তো এই বইকে আত্মজীবনী বলতে চাই না, কোনও পূর্ণাঙ্গ জীবনী নয়, এটা নেহাতই স্মৃতিচারণা।

কী জানো, বাবা-মায়ের কাছ থেকে তো আমরা সবটাই সরাসরি পাই না, অনেক কিছু তৈরি হয় তাঁদের প্রতি প্রতিক্রিয়া থেকেও। সে দিক থেকে আমি অনেক বেশি ব্যক্তিগত। বলতে পারো খানিকটা ‘ইংরেজ’ ধাঁচের, বলেছি না, কী ভাবে অনেক দুঃখ-কষ্টেও ইংরেজদের উপরের ঠোঁটে প্রভাব পড়ে না! তবে আবেগের কথা একেবারে বলিনি, বলি না, তা-ও নয়। বইয়ের শেষে রয়েছে, যাঁদের হারিয়ে ফেলেছি, তাঁদের সঙ্গে কত কথা বাকি রয়ে গেল। ‘মনে কী দ্বিধা’ রেখে তারা চলে গেল। এই হারিয়ে-যাওয়া সম্ভাবনাগুলো আমাকে গভীর ভাবে পীড়া দেয়। এখনও কত সময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাত্‌ আবিষ্কার করি, আমি মনে মনে কথা বলছি এমন কারও সঙ্গে যিনি আর নেই। একটা ঘটনা তাঁকে বলতে হলে, আলোচনা করতে হলে যে ভাবে বলতাম সেটাই মনে মনে বলে যাচ্ছি নাটকের সংলাপের মতো...


ছোটবেলার কলকাতা-শান্তিনিকেতনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে হয়তো এর একটা যোগ আছে। ভূমিকায় লিখেছি, উত্তর কলকাতার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বালক থেকে বিশ্বায়িত বুদ্ধিজীবী হয়ে-ওঠার কাহিনির মধ্যেই নিশ্চয় আমার মধ্যেকার এই নিরুত্তাপ বীতস্পৃহার উত্‌স। কত পরিবেশে কত লোকের সান্নিধ্যে এসেছি, কিন্তু কোনও কিছুই আমাকে গদগদ আবেগ-আপ্লুত করতে পারেনি। একটা চটুল সপ্রশ্ন মন সব সময় গাম্ভীর্যের পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিয়েছে। কলকাতার বাড়ির পরিবেশ তো বটেই, শান্তিনিকেতনে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর জীবন থেকে হয়তো এই বীতস্পৃহা তৈরি হয়েছিল এক দিন।


নিশ্চয়ই। উত্তর-আধুনিক দাবিটা কিন্তু ঠিক বলেই মনে করি। স্মৃতি আমারই তৈরি। ব্যক্তিগত নির্মাণ। স্মৃতির কথা যখন বলছি আমি আসলে নিজের দেখাটুকুই বলছি। তার বেশি কিছু নয়। সেই জন্যেই তো বলছি, এই বই কোনও প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে যেন দেখা না হয়। এটা একটা আড্ডার বই, মজলিশি লেখা...


কী জানি... সে তোমরা বলবে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.