‘এক যে ছিল শহর। নাম ২০১৩। ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়েছিলাম।’
তার পর? ধেয়ে এল বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা। দেখে ফেললেন চিরশ্রী মজুমদার।
|
গেরুয়া পতাকায় বিশালাক্ষরে লেখা, ওঠো, জাগো। আসছে ‘স্বামী বিবেকানন্দ ১৫০’ ব্যানার সাঁটা ট্যাবলো। তাতে কারা বেদম তলোয়ার খেলছে। রাস্তার ধারে সরে আসতেই কানের কাছে জনার্দনদা ফের ফরফর করে উঠল, ‘আরে নমো করো!’ তার পর বলল, ‘চল, আমি সব দেখিয়ে-চিনিয়ে-বুঝিয়ে দিচ্ছি। ২০১৩-তে একা ঘুরোনি গো দি’ভাই। মেয়ে দেখলেই মানুষে ধরবে।’ বলে একটা ট্যাক্সি ডেকে তুলে দিল ঠেলেঠুলে।
ঝকঝকে জায়গাটা আসতেই ট্যাক্সিটা ব্রেক কষল, ঘ্র্যাঁআ্যঁচ। মিটার পড়ে, খাতা পেনসিল বের করলাম। কিন্তু, ‘দিন না নোটটা তাড়াতাড়ি’ বলে কড়কড়ে সবুজ ১০০ টাকার নোট হাত থেকে ছিনিয়ে ট্যাক্সিওলা বোঁওও বেরিয়ে গেল। পেছনে দুদ্দাড়িয়ে ছুটছি। ২০ টাকা ৮০ পয়সা ফেরত পাই-ই-ই। জনাদা চুপ করাল। এখানে ‘ইজিয়ার কে সি নাগ’ চলে। ১০০ থেকে ৯৩ বাদ দাও বা ৫০০ থেকে ৩৬৫, রেজাল্ট ইউনিভার্সালি শূন্য। শুনে চমকাব কী? তার আগেই গালির বর্ষণ শুনে কানে আঙুল। সব হাইরাইজগুলোয় পাথর ছুড়ছে, বিশাল অফিসগুলোর সামনের ধরনা দিয়েছে। কী হয়েছে? মালিক গাঁয়ে-গঞ্জে লটারি বিক্রি করে বিশাল ব্যবসা ফেঁদেছিল। সেটা ডুবেছে, ব্যবসায় যারা লগ্নি করেছিল তারা সর্বহারা, যারা সে সব ব্যবসায় চাকরিবাকরি করত তাদেরও মাথায় বাজ। তাই সবাই এখন রাজপ্রাসাদের বাইরের রাস্তায় বসে পড়েছে। একটা স্যুটেড-বুটেড লোককে দেখলাম দৌড়তে দৌড়তে এ দিকেই আসছে। নিশ্চয়ই সেই রাজামশাই। পিছনে ওই তো পুলিশ। কিন্তু কাছে আসতেই তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। ধপধপে সাদা জামা, গালে পাকা দাড়ি। তার পরই ভ্যানিশ!!! ও পারের অমন অগ্নিগর্ভ জটলাও হাওয়া। জনাদার ঝোলায় এসএমএস বাজল, ও চুপ করে থেকে বলল, ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা গেলেন। |
শুনলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষের রক্তে ছিল অসীম ক্রিয়েটিভিটি। অগাধ পাণ্ডিত্য। কিন্তু, তিনি ছিলেন রূপান্তরকামী মানুষ। তাই নিয়ে পাবলিক হেভি হাসত, টিটকিরি মারত, এখন হঠাত্ মারা যেতেই, সব কহাশুনা মাফ। কী সম্মান! কী সম্মান! গোটা শহর একত্রে কাঁদছে। রাষ্ট্র নিজে তাঁকে কামান ছুড়ে সেলাম ঠুকে, ভীমের মতো একলা কাঁধে চড়িয়ে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছে। আর, কোন আহাম্মক বলেছিল ব্যাটা ২০১৩ অলক্ষুণে, মেয়েদের সম্মান দেয় না, আঁধারে ডোবা এরিয়া। এ বার তোমরা সব এসে দেখো, সবাই মিলে প্ল্যাকার্ড টাঙিয়েছে, ‘বনমালী তুমি পরজন্মে হয়ো রাধা’। আর এদের ‘পিছিয়ে থাকা’ বলেছিলে! মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করতে যাব, এমন সময়, কোত্থেকে আনটাইমলি বর্ষা এসে ঝমঝম করে চান করিয়ে দিল!
জনাদা দেখছি এরই মধ্যে বিশাল ফুর্তি পেয়েছে। একটা কলি ভাঁজছে। সুরটা ইন্টারেস্টিং, কিন্তু কথাগুলো শুনলে ঘিলু তালগোল পাকিয়ে যায়। জনাদা প্রচুর গরম দেখাল। ‘হাঁ, যেহেতু আমাকে নিয়ে, আমাদের জন্য একখান বই বানিয়েছে, অমনি যত কথা! কোটি টাকা কামাচ্ছে এই চেন্নাই এক্সপ্রেস। তার সারকথাটা জান তো, ডু নট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব আ কমন ম্যান।’ ‘তোমাক্কে ন্নিয়ে?’ ‘আরে আমার পুরো নাম জানো না? জনতা জনার্দন। হুঁহুঁ বাওয়া!’ অমনি রইরই করে এসে পড়ল ঘূর্ণিঝড়!
অগত্যা বাকি রাস্তা ছাতা মাথায়, গামবুট পরে, হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করতে করতে এগোতে হল। যত যাচ্ছি, পিলে চমকাচ্ছে। এ মুলুকে কেউ মুখে কথা কয় না। টুইট করে, আপডেট দেয়, হাসি পেলে চ্যাটে গিয়ে ফোকলা স্মাইলি পাঠায়! রাস্তায় বেরোলে, আগু-পিছু-ডাইনে-বাঁয়ে তাকাতে লাগে না। শুধু থান ইটের মতো মোবাইল বার করে প্যাটপ্যাট করতে করতে চলে। সামনে কী আছে সেটা তাদের স্মার্টফোনেই দেখাচ্ছে। তবে, দেখে দুঃখ লাগল, প্রায় সবাই বধির, কানে তার বা কালো ছোট্ট পেন-টাইপের যন্ত্র। দৃষ্টিশক্তিও কম, দেখতে চোখের সামনে ক্যামেরা ধরতে লাগে। কিন্তু ইমোশন ঢেলে দিয়েছেন ভগবান! মৃত্যুই এ তল্লাটের সেরা উত্সব। কখনও মান্না দে-র গান গেয়ে কাঁদছে, কখনও ম্যান্ডেলার ছবি নিয়ে বুক চাপড়াচ্ছে। এক সময় তো কী তড়পাচ্ছিল সবাই: বুড়োটাকে বিদেয় কর, তার পরই উদোর মতো জাম্প মারল ও তেন্ডুলকরের ক্রিকেট-মৃত্যু দেখে ‘২৪ বছরের সাজানো বাগান মুড়িয়ে গেল’ বলে টিভির সামনে গড়াগড়ি গেল। উগো চাভেস, থ্যাচার, পল ওয়াকার সব্বার শ্রাদ্ধে হাতে রুমাল ও বালতি নিয়ে হাজির। শুধু গলাটা নামিয়ে পাশের জনকে শুধিয়ে নিল, কে গা উনি?
আমি তো চমকপ্রুফ হয়ে গেছি। কিন্তু বাঁক ঘুরতে দেখি, সিরিয়াস মুখে বিরাট প্ল্যাকার্ড টাঙাচ্ছে: ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী... আরে! ওই দেখে কারা কাঁদছে এত! কয়েক পাক আগে যারা ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে আহাউহু জুড়েছিল, তারাই বা ওদের দেখে দরজা দিচ্ছে কেন? ও জনাদর্ন’দা কোথায় গেলে? ঘুলিয়ে যাচ্ছে সব। বুঝিয়ে দাও গো!
সটকে পড়ল? না না ওই তো! ভাল জামাকাপড় পরে শপথ নিচ্ছে! কারা ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে মন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছে। আম আদমিও পাওয়ার-এর মইয়ে চড়ে সেলিব্রিটি, খোদ দিল্লির বেতাজ বাদশা। সেই গোঁত্তায় আমি ছুটতে ছুটতে শহরের প্রায় বাইরে। উড়তে উড়তে একটা কাগজ পড়ল সামনে। লেখা, ‘আশির দশকে সাধারণ মানুষের চরিত্রায়ণের জন্য প্রশংসিত অভিনেতা ফারুক শেখ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে...
ওই দেখা যায়, আবার উত্সব লাগল শহরে! কিন্তু, এই অকালে, কেন হল ওঁর হার্ট অ্যাটাক? |