আসরে নামতেই হল সনিয়া গাঁধীকে। ‘রাগী’ ছেলের ঠেলা সামলাতে।
ভোটের আগে দলের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন গড়ে তুলতে গিয়ে ‘কংগ্রেসের নিজস্ব কেজরিওয়াল’ রাহুল গাঁধীকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন সনিয়া। সে দায়িত্ব পালন করতে দিয়ে রাহুল কখনও নিজের সরকারের বিল ছিঁড়ে ফেলার কথা বলছেন, কখনও দলেরই কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে চাপে ফেলে দিচ্ছেন। যেমনটি হয়েছে গত কাল। আদর্শ আবাসন দুর্নীতি নিয়ে মহারাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই বলে মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণের গদিটাই প্রায় টলিয়ে দিয়েছেন রাহুল! যার জেরে বিজেপির রাজনাথ সিংহরা এখন সুযোগ পেয়ে পৃথ্বীরাজের ইস্তফার দাবি নিয়ে সরব হয়েছেন। দুর্নীতি প্রসঙ্গে রাহুলের এই অতি-আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দলের পুরনো সৈনিকদের মধ্যে ত্রাহি-ত্রাহি রব উঠতে শুরু করেছে। মহারাষ্ট্রের নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দের মতো অনেকের ধারণা, রাহুলের এই মন্তব্য আসলে দলকেই বিপাকে ফেলছে। এ ভাবে চাপ বাড়লে পৃথ্বীরাজের ইস্তফা দেওয়া ছাড়া অন্য পথ থাকবে না বলেও মনে করছেন এই নেতারা। এই অবস্থায় দলের একটা অংশের ক্ষোভ নিরসনে আজ আসরে নামতে হল কংগ্রেস সভানেত্রীকেই।
আজ কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে দিল্লিতে দলের সদর দফতরে অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সনিয়া। গত কাল রাহুল সুর চড়ানোর পরে দলের অন্দরের প্রতিক্রিয়া বুঝে আজ যেন কিছুটা ভারসাম্যের পথেই হাঁটলেন তিনি। প্রথমেই বলে দিলেন, “আমাদের কাছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা একজোট থেকে লড়াই করে (নির্বাচন) জেতার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।” এর পরে আদর্শ আবাসন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সনিয়া জানিয়ে দেন, এ ব্যাপারে রাহুলের মন্তব্যের ধাক্কায় হারিয়ে গিয়েছে তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকের মূল বিষয়টিই। সনিয়ার মন্তব্য, “আসলে গত কাল কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকের মোদ্দা বিষয়টিই হারিয়ে গিয়েছে। বৈঠকটি মূলত কেন্দ্রীভূত ছিল দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীরা রাজ্যে রাজ্যে কী ব্যবস্থা নিতে পারেন, তা ঠিক করার।”
এ টুকু বলেই চলে যেতে চাইছিলেন সনিয়া। এ সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আদর্শ নিয়ে কি দ্বিচারিতা করা হচ্ছে না? সরাসরি তার জবাব না দিয়ে সনিয়া বলেন, “সেটি গত কালই স্থির হয়ে গিয়েছে। আমি মনে করি, এই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।” কোন পথে নিষ্পত্তি হবে, তা অবশ্য ব্যাখ্যা করেননি সনিয়া। কিন্তু রাহুলের মন্তব্য নিয়ে তৈরি হওয়া আলোড়ন সামাল দিতে সনিয়া বিষয়টির মোড় ঘোরানোরও চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “সংবাদমাধ্যমকে আমি অনুরোধ করব, অন্য দল শাসিত রাজ্যের দুর্নীতি, বিশেষ করে তাদের কিছু মন্ত্রীর দুর্নীতির বিষয়টির দিকেও নজর রাখুন। আমাদের ভুল-ত্রুটিও তুলে ধরুন, কিন্তু অনুগ্রহ করে অন্যদের দিকেও তাকান।”
রাহুলের এই ‘অ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান’ ভাবমূর্তি নিয়ে আজ একটি ব্লগও লিখে ফেলেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতা অরুণ জেটলি। তাঁর বক্তব্য, ‘রাহুল যদি দুর্নীতি মোকাবিলায় এতই উদগ্রীব হন, তা হলে যখন তাঁর নাকের ডগায় একের পর এক বড় মাপের দুর্নীতি হচ্ছিল, তখন এই রাগ কোথায় ছিল? দুর্নীতিতে অভিযুক্ত লালুপ্রসাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধতে চাইছে কংগ্রেস। অথচ তাঁর কোনও রাগ নেই! টু-জি দুর্নীতিতে রাজকোষের বিপুল অর্থ লোকসান হল। তা নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি গায়ের জোরে সাজানো রিপোর্টও দিয়ে দিল। অথচ রাহুলের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই! কয়লা ব্লক বণ্টনে দুর্নীতি হলেও এখনও পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়নি। রাহুল চুপ!’ এই সঙ্গেই জেটলি জানান, ‘আদর্শে দুর্নীতি হলে দোষীকে সাজা দিতে তাঁর বাধছে কোথায়? রাগ না করে পদক্ষেপ করলেই তো পারেন।’
কংগ্রেসের এক সূত্রের বক্তব্য, রাহুলকে সামনে রেখে তাঁকে ‘কেজরিওয়াল’ হিসেবে গড়ে তোলা যেমন দলের কৌশল, তেমনই ক্ষোভ ঠেকাতে সনিয়ার আসরে নামাটাও সেই কৌশলেরই অঙ্গ। মনমোহন সিংহ জমানার বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ থেকে নিজেকে দূরে রেখে এখন নিজের একটি আলাদা ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করছেন রাহুল। তরুণদের সঙ্গে নিয়ে নিজস্ব ‘টিম’ও তৈরি করছেন। তার উপর তাঁর নিত্যনতুন মন্তব্যে গোঁসা বাড়ছে দলের পুরনো নেতাদের। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে মাঠে নামাটাই লক্ষ্য সনিয়ার। সে কারণেই ক্ষোভ কমাতে তাঁকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়েছে। |