কলকাতা কারে কয়?
স্রেফ ঔপনিবেশিক স্থাপত্য বা সেকেলে কালিঝুলি মাখা গলিতে সিপিয়া টোনের অতীতচারিতা নয়। আজকের কলকাতা খুঁজছে তার নতুন পরিচয়। সাবেক সাহেবপাড়া পার্ক স্ট্রিটের নতুন রূপটানের সূত্র ধরেই এ বার ফুটে উঠছে তার ইমেজ মেকওভার-এর তাগিদ।
বড়দিনের মরসুমে পার্ক স্ট্রিটে এ বছরের বাহারি আলোর সাজ থেকেই উঠে আসছে কলকাতার নতুন পরিচয়ের একটা দিক। উৎসবের সন্ধেয় পার্ক স্ট্রিটের আলোর কিছু কারুকাজ বরাবরের মতো রেখে দিয়ে শহরের বিশিষ্ট রাজপথটিকে দেশ-বিদেশের আগন্তুকের সামনে বিশেষ ভাবে তুলে ধরতে আগ্রহী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী ভাবে? পার্ক স্ট্রিটের আলোর সাজের সবটা রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী নন মমতা। কিন্তু চৌরঙ্গির দিক থেকে রডন স্ট্রিট পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিট ছেয়ে যে পরপর ধবধবে আলোর ‘আর্চ’ তৈরি হয়েছে, তা পার্ক স্ট্রিটের পাকাপোক্ত আভরণ হয়ে উঠুক, চান তিনি। মহানগরের এ কাল-সে কালের ঐতিহ্যশালী সরণিটিকে কুর্নিশ জানিয়ে পর্যটকের চোখের সামনে তুলে ধরতেও এই আলোর সাজ কার্যকর হবে বলে তাঁর বিশ্বাস। এমন আলোর সাজে পার্ক স্ট্রিট তথা কলকাতার একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে বলেও তিনি মনে করছেন। |
ব্র্যান্ডিং বা ইমেজ মেকওভারের বিষয়গুলি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য এই পরিকল্পনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। বিজ্ঞাপন জগতের পোড় খাওয়া পেশাদার রাম রায় যেমন মনে করেন, “উৎসবের ক’দিনের সাজগোজ অস্থায়ী বলেই আমাদের ভাল লাগে। তা রোজকার ব্যাপার হয়ে উঠলে কিন্তু আকর্ষণ ফিকে হতেও পারে।” তবে সে বিষয়টিও মুখ্যমন্ত্রী যে মাথায় রাখেননি, তা নয়। মুখ্যমন্ত্রী ভাবছেন, পার্ক স্ট্রিটে আলোর সাজের রং ঋতু বা সময়বিশেষে বদলানো যেতে পারে। পার্ক স্ট্রিটের এই আলো এলইডি-র মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে এমনিতে খুব বেশি বিদ্যুৎ খরচ হবে না। তাই পরিকল্পনাটি বাস্তবানুগ বলে মনে করছে রাজ্য প্রশাসন।
বাস্তবিক, এ রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকেই কলকাতার নতুন ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। আগেও বি বা দী বাগ অঞ্চলে, রাস্তার রেলিং নীল-সাদা রং করে কিংবা শহরময় ত্রিফলা আলো বসিয়ে বা ডিভাইডারের সৌন্দর্যায়নের মধ্যে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বার্তা নান্দনিকতার, আবার কলকাতার নতুন পরিচয় গড়ে তোলারও বলে মনে করা হচ্ছে।
শহরের গঙ্গার ঘাটের সৌন্দর্যায়নে কাজটাও একই লক্ষ্য সামনে রেখে গতি পেয়েছে বলে মনে করছেন সরকারি কর্তারা। প্রিন্সেপঘাট থেকে আউটরাম ঘাট সুন্দর ভাবে সাজানোর পাশাপাশি, বিদ্যাসাগর সেতুও এখন আলোয় উদ্ভাসিত। পুজোর সময়ে সেতু আলোকিত করা হলেও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সেই আলো এখনও সেতুর শোভা হয়ে রয়েছে। পার্ক স্ট্রিটের আলোও মুখ্যমন্ত্রী নিজে পছন্দ করেছেন। লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের প্রেরণায় এই আলোকসজ্জা চন্দননগরের শিল্পীদের সৃষ্টি।
সরকারের নজর রয়েছে, আলো-ফোয়ারা-গাছগাছালিতে সেজে ওঠা নিউ টাউনের ইকো-ট্যুরিজম পার্ক এবং ওই তল্লাটের সামগ্রিক সৌন্দর্যায়নের দিকেও। হিডকো-র চেয়ারম্যান তথা এমডি দেবাশিস সেন শনিবার জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নিউ টাউনের আলোকসজ্জা নিয়ে এ দিনই বৈঠক হয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাটে দরকারি সাধারণ আলো ছাড়াও এলইডি আলোর সাজ ফি সন্ধ্যায় বহাল করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন ভাড়া করে এই আলো বসানো থাকলেও তা কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে স্থানীয় প্রশাসনের।
কলকাতার সাবেক চেহারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সব একেলে সাজসজ্জায় শহরের ভাবমূর্তি নতুন প্রাণ পাবে বলেও অনেকের বিশ্বাস। বিজ্ঞাপন জগতের পেশাদার রাম রায়ই বলছেন, “কোনও শহরের ইমেজই এক জায়গায় ফ্রিজ করে থাকে না। সেটা পাল্টায়। কলকাতার সাজসজ্জা ইমেজের বিকাশ ঘটাতে পারলে তো সেটা ভালই হবে!” |