দরখাস্ত রেখে যান, সাহেব এসে দেখবেন |
রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় • বাঁকুড়া |
ওঁরা এসেছেন ‘সার্চিং’ করাতে।
কিন্তু করবে কে? আপার ডিভিশন ক্লার্ক ছুটি গিয়েছেন। তাঁর শূন্য চেয়ারে কে বসবে, সেটারই সার্চ চলছে।
ওঁরা এসেছেন সকাল-সকাল। কারও হাতে মিউটেশনের দরখাস্ত। কারও হাতে জমির দাগসূচি খতিয়ে দেখার অর্থাত্ সার্চিংয়ের কাগজ।
সকাল ১০টায় দোর খুলল বটে, কিন্তু মন্দির শূন্য। সেখানে প্রথম পা পড়ল চতুর্থ শ্রেণির কর্মী আনন্দময় গোস্বামীর। তখন সওয়া ১০টা বেজে গিয়েছে। কিন্তু বাইরে অপেক্ষমান জনতার অবশ্য তখনও অফিসে ঢোকার অনুমতি মেলেনি।
পরের পনেরো মিনিটে একে-একে রেভিনিউ অফিসার বিপ্লবকুমার দাস আর হেডক্লার্ক গৌতম দাস এসে ঢুকলেন। বিপ্লববাবুর ঘরেই বসেন আরেক রেভিনিউ অফিসার অঞ্জন মালাকার। এক অফিসারকে আসতে দেখে দু’জন আগন্তুক গুটিগুটি পায়ে হাজির। হাতে মিউটেশনের দরখাস্ত।
আগন্তুকদের উদ্দেশে বিপ্লব: ‘দরখাস্ত টেবিলে রেখে দিন, সাহেব এসে দেখবেন।’ শূন্য টেবিলে চিত হয়ে বিশ্রাম নিতে লাগল দরখাস্ত। ‘সাহেব’ অঞ্জনবাবু যখন এলেন, তখন প্রায় বেলা পৌনে ১১টা। পাঁচ জন আপারডিভিশন ক্লার্কের চেয়ার ফাঁকা। |
বেলা গড়াতে দেখে গা ঝাড়া দিয়ে বিপ্লববাবু কাজ শুরু করলেন। সকাল থেকে হত্যে দিয়ে থেকে পুয়াবাগানের ধনপতি ঘোষ যখন ডাক পেলেন, সাড়ে ১১টা পেরিয়ে গেছে। আরেক রেভিনিউ অফিসার পার্থ মুখোপাধ্যায় তখন সবে অফিসে ঢুকছেন। তাঁর টেবিলেও স্পর্শের অপেক্ষায় শুয়ে মিউটেশনের দু’টি দরখাস্ত।
অফিস মোটামুটি জমল, তখন বারবেলা পেরিয়ে গিয়েছে। তখনও কিছু আপারডিভিশন ক্লার্ক বেপাত্তা। জানানো হল, বাতাসে বড়দিন, তাই অনেকে ছুটি নিয়েছেন। খোদ ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক দেবাশিস মণ্ডলও দু’দিনের ছুটিতে। তোমার আসন শূন্য আজি... হ্যাপা সামলাতে অন্য কেউ চার্জে নেই। ক্যাশিয়ার শুভময় বন্দ্যোপাধ্যায়ও অফিসে ঢোকেননি। ব্যাপার কী? জবাব আসে: “উনি অফিসেরই কাজে ব্যাঙ্কে গিয়েছেন। ফি শুক্রবারই যান।”
এরই মধ্যে শীতের রোদ মাখতে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন কয়েক জন আপার ডিভিশন ক্লার্ক আর গ্রুপডি কর্মী। জমি সার্চিং করাতে আসা মানুষগুলো দূর থেকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তাঁদের দেখিয়ে জিগ্যেস করা হল এঁরা কি দাঁড়িয়েই থাকবেন? সার্চিংয়ের কাজ শুরু হচ্ছে না কেন? উত্তর: “আসলে এই কাজটা যে আপার ডিভিশন ক্লার্ক করেন তিনি দু’দিনের ছুটিতে গিয়েছেন।” তা হলে আজ সার্চিং হবে না? নির্বিকার গলায় জবাব এল: ‘হবে তো! কেউ না কেউ বসবে একটু পরে।’
জটলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বাঁকুড়ার পাটপুরের বাসিন্দা কুন্দন দাস। বিরক্তি ঝরে পড়ে তাঁর গলায়, “একটা জমি কিনেছি। সেটার আসল মালিক কে, তা জানতে এসেছি। কিন্তু দরখাস্তটাই তো কেউ জমা নিচ্ছে না! বলতে গেলেই বলছে, বাইরে অপেক্ষা করুন। এখানে এই রকমই চলে।” সার্চিং করাতে এসে ক্লান্ত রাজগ্রামের কান্তিময় কুণ্ডুুও। দরখাস্ত হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু তা নেওয়ার মতো কেউ নেই। |
বিকেল ৪টে নাগাদ অফিসের বাইরের চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন বেশ কিছু অফিস কর্মী। চোখাচুখি হতেই মুচকি হেসে এক জন বলে উঠলেন, “কাজ সেরে একটু চা খেতে বেরোলাম। এতেও আবার আপত্তি নেই তো?” জমি সার্চিংয়ের দরখাস্ত হাতে তখন হতাশ পায়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছিলেন ওন্দার প্রবীর মালাকার। কাজ হল না? “নাহ্! বাঁকুড়ায় সস্তায় একটা জমি পেয়েছি। জমিটা কী অবস্থায় রয়েছে, তা জানতে সার্চিং করাতে এসেছিলাম। তা ওঁরা বললেন, দুপুর দেড়টার পরে আর সার্চিং হয় না। সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কাল আবার আসতে হবে।”
কাল, কাল, কাল... ‘আজ’ নেই, ‘এখনই’ নেই। সব মহাকালের গ্রাসে।
|