নাদুসনুদুস পা’গুলোতে দগদগে লাল ঘা। তার উপর ভনভন করছে মাছি। কিন্তু হায় রে গজরাজ! ঘায়ের যন্ত্রণায় কাবু হলেও লোহার শিকলের বাঁধন থেকে নিস্তার নেই। অগত্যা তাই নিজের ছোট্ট চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে থাকা, যত ক্ষণ পর্যন্ত দিন না শেষ হয়।
দিন ফুরোলে পিছনের পায়ের শিকলদু’টি খুলে দেওয়া হয়। তখনই জিরোনোর ফুরসত মেলে। সকাল হতেই ফের শুরু ‘অত্যাচার’। দগদগে লাল ঘা পায়ে নিয়ে রোদ্দুরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা।
বিশ্বাস না হলে, এক বার সফর করে আসতে পারেন ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া চিড়িয়াখানায়। ৩৭ একর জমির উপর তৈরি এই চিড়িয়াখানা এখন তিন হাজারেরও বেশি প্রাণীর ঘরবাড়ি। দর্শকরা মাঝেমধ্যেই ভিড় জমান এখানে। কিন্তু চিড়িয়াখানার বাসিন্দাদের করুণ অবস্থা দেখে তাঁদেরও চোখ জলে ভরে যায়। তথ্য বলছে, স্রেফ পরিচর্যার অভাবে বা বিনা চিকিৎসায় তিন মাসে পঞ্চাশটিরও বেশি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এখানে। চিড়িয়াখানার বীভৎস দশা অবশ্য গত বছরই নজরে এসেছিল। এখানকার বাসিন্দা এক জিরাফের নিথর দেহ থেকে প্রায় ২০ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক ব্যাগ মেলায় তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল তখন। পরে জানা যায়, জিরাফটির ‘এনক্লোজার’-এ প্লাস্টিক ব্যাগগুলি কোনও ভাবে উড়ে এসে পড়েছিল। কিন্তু প্রাণী-পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়কের সে জঞ্জাল সাফ করার সময় হয়নি। সেগুলিই গিলে ফেলে জিরাফটি। পরিণাম মৃত্যু।
কিন্তু তার পরও ছবিটা বদলায়নি। সম্প্রতি সুরাবায়া চিড়িয়াখানা নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা ব্রিটেনের সংবাদপত্রে লিখেছেন এক দর্শক। ছবিও তুলেছেন বেশ ক’টা। সেখানেই দেখা যাচ্ছে, এনক্লোজারে বসে আপনমনে কলম চিবোচ্ছে এক ওরাংওটাং। যে কোনও মুহূর্তে কলমটি গিলেও ফেলতে পারে। আশপাশে অবশ্য তখনও কোনও তত্ত্বাবধায়কের দেখা নেই। অথচ এই ওরাংওটাংয়েরই আর এক সঙ্গী সম্প্রতি অন্ত্রে টিউমারের কারণে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তার পরে বিস্তর ঝামেলাও হয়েছিল। তবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি।
কিন্তু কেন এই বেহাল দশা? সুরাবায়া চিড়িয়াখানার পরিচালন সমিতির এক প্রাক্তন সদস্য টোনি সুমামপৌ-এর মতে, “চিড়িয়াখানার নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যক্তিগত দোকান রয়েছে। তাঁরা সে সব চালাতেই ব্যস্ত। আসলে প্রাণীদের দেখভালের থেকে তাঁদের কাছে অর্থ উপার্জন ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।” তা ছাড়া ১৯১৬ সালে চালু হওয়ার পর থেকে আর কোনও উন্নয়ন হয়নি এখানে। জায়গা বাড়েনি। যদিও প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকার তাদের দেখভালের অন্য ব্যবস্থা করছে না কেন?
আসলে ইন্দোনেশিয়ার বন মন্ত্রক সুরাবায়া চিড়িয়াখানার বাসিন্দাদের অন্য জায়গায় পাঠানোর কথা বলেছিল। কিন্তু কোনও চিড়িয়াখানাই তাদের নিতে রাজি নয়। কারণ বাকিদের আশঙ্কা, পরিচর্যার অভাবে হয়তো বড়সড় রোগে ইতিমধ্যেই ভুগছে সুরাবায়া চিড়িয়াখানার প্রাণীরা। তারা এলে সে রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে সুস্থ প্রাণীরাও। অতএব তারা ব্রাত্য।
এখনও তাই দেড়শো পেলিক্যানের জন্য বরাদ্দ সেই ছোট্ট খাঁচা। আর সেখানে যে কুয়ো রয়েছে, তা এতটাই ছোট যে দশটি পেলিক্যানও একসঙ্গে ভেসে বেড়াতে পারবে না। অগত্যা তাই খাঁচার শিকেই থম মেরে থাকছে তারা। মাঝেমধ্যে ইতস্তত ওড়াউড়ি। একটু এগোলেই নজরে আসবে উটের এনক্লোজার। কিন্তু সেখানে যাদের দেখা মিলবে, তাদের অন্তত মরুভূমির জাহাজ হিসেবে কল্পনা করা সম্ভব নয়। শীর্ণ, ক্ষয়াটে, হাড় গোনা যায় এমন অবস্থায় তারা পড়ে রয়েছে। যত্নআত্তি দূর অস্ত, নিত্যদিন খাবারও জোটে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। সুরাবায়া চিড়িয়াখানার দর্শকরা অবশ্য আর একটি প্রাণীর কথা বলে থাকেন প্রায়ই। এক কাপুচিন বাঁদরের কথা। দর্শকরা যখনই ওর খাঁচার পাশ দিয়ে যান, তখনই তড়িঘড়ি দৌড়ে তাঁদের কাছে ছুটে আসে বিশেষ প্রজাতির বাঁদরটি। চোখটা যেন ছলছল করছে। কাতর চোখে মুক্তির প্রার্থনা করে চলেছে সে। তারই মতো আর এক ভুক্তভোগী রাইনোসরাসটির অবশ্য মুক্তির আশা নেই। নোংরা জলাশয়ে গা ডুবিয়ে বসে থাকে সে। আর মাঝে মধ্যে মুখ খোলে। অলক্ষে কাউকে নিজের দুর্দশার কথাই বলতে চায় বোধহয়।
এত কিছু সত্ত্বেও চিড়িয়াখানার মুখপাত্র অ্যাগাস সুপাংকাতের প্রত্যয়ী দাবি, পরিস্থিতি আগের থেকে অনেক ভাল। তবে ‘এখনও কিছু সমস্যা রয়েছে’ বলে বিষয়টি হালকা করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু তিন মাসে পঞ্চাশটি প্রাণীর মৃত্যুর পরিসংখ্যান যে খুব সহজে ভোলা সম্ভব নয়, সেটা অ্যাগাসও বিলক্ষণ জানেন। জানে প্রশাসন, গোটা বিশ্ব। শুধু জানে না ওই অসহায় বাসিন্দারা।
ঘা নিয়ে বেঁচে থাকাই তাদের নিত্যজীবন। অযত্নে মৃত্যুটাই যাদের স্বাভাবিক পরিণতি। |