অস্তগামী বছরের স্মৃতিচারণ করিতে বসিলে ২৪ এপ্রিল ঢাকার রানা প্লাজা পোশাক কারখানার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা অন্তর্ভুক্ত হইবেই। সহস্রাধিক মৃত্যু এবং শত শত পরিবারের সর্বনাশ, তদুপরি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সামগ্রিক পরিস্থিতি লইয়া আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও প্রতিবাদ ঘটনাটির গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। কিন্তু শুধু তাহাই নহে, বছরের শেষে এই ঘটনাটি অন্য একটি কারণেও সংবাদের শিরোনামে ফিরিয়া আসিয়াছে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে ওই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের এক বড় উদ্যোগ চূড়ান্ত হইয়াছে। উদ্যোগটি ত্রিপাক্ষিক। বাংলাদেশ সরকার, শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সক্রিয় কিছু অসরকারি সংগঠন এবং রিটেল ব্যবসায়ে যুক্ত কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সমবেত ভাবে প্রায় চার কোটি ডলার মূল্যের একটি তহবিল গড়িতেছে। এই তহবিল হইতেই নিহত পোশাক-কর্মীদের পরিবারবর্গকে এবং আহত কর্মীদের ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া হইবে। আগামী ফেব্রুয়ারি হইতেই অর্থ বণ্টন শুরু হওয়ার কথা।
ক্ষতিপূরণের এই সমবেত উদ্যোগটি তাৎপর্যপূর্ণ। অসরকারি সংগঠন বা সরকারের ভূমিকা সহজবোধ্য। রিটেল কোম্পানিগুলির ভূমিকা ঈষৎ জটিল। বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় বিভিন্ন বহুজাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক তৈয়ারি হয়। বিভিন্ন রিটেল সংস্থা কারখানাগুলিকে বরাত দিয়া থাকে। বরাত অনুযায়ী পণ্য বুঝিয়া লওয়া এবং তাহার জন্য নির্ধারিত দাম চুকাইয়া দেওয়ার কাজেই সংস্থাগুলির দায়িত্ব সম্পন্ন হইবে, ইহা বাজারের ধর্ম। কারখানাগুলি কী ভাবে চালানো হইতেছে, শ্রমিকদের মজুরি, সুযোগসুবিধা এবং নিরাপত্তার যথেষ্ট বন্দোবস্ত সেখানে আছে কি না, তাহা আপাতদৃষ্টিতে বাজারের বিচার্য নয়, সুতরাং রিটেল সংস্থা বলিতে পারে তাহারও এই বিষয়ে মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই। তাহা হইলে ক্ষতিপূরণের উদ্যোগে তাহারা যোগ দিতেছে কেন?
একটি কারণ নিশ্চয়ই স্বাভাবিক মানবিকতা। ব্যবসায়িক সংস্থার পক্ষেও দরিদ্র নারীশ্রমিক ও তাঁহাদের পরিবারের মর্মান্তিক পরিণতির মানবিক দায় এড়ানো কঠিন। সাধারণ ভাবেই, বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার ‘সামাজিক দায়িত্ব’র আধুনিক ধারণাটির পিছনে মানবিকতার ভূমিকা আছে। এই ধারণা ধনতন্ত্রের বিবর্তনের সহিত উঠিয়া আসিয়াছে উনিশ শতকের ইংল্যান্ডের নবীন ধনতন্ত্রের নিকট কেহ ‘কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি’ প্রত্যাশা করিত না। দ্বিতীয় মাত্রাটি ব্যবসায়িক স্বার্থের। বস্তুত, উপরোক্ত মানবিকতাও স্বার্থবুদ্ধিরহিত নয়। তৃতীয় বিশ্বের সুলভ শ্রমিক ব্যবহার করিয়া বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ যদি কাজে লাগাইতে হয়, তবে বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে তৃতীয় বিশ্বে শিল্পের সুস্থায়ী পরিকাঠামো বজায় রাখিতে হইবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি অর্থনীতির দৌড়ে যত অগ্রসর হইবে, মজুরি, সুযোগসুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই উন্নতির দাবি তত জোরদার হইবে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পেও এই দাবি অনেক দিন যাবৎ উঠিয়াছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা সেই দাবিকে নূতন তীব্রতা দিয়াছে। এই দাবির মোকাবিলা করিয়া চলিতে না পারিলে পোশাক শিল্পের কাঠামোটিই বিপর্যস্ত হইতে পারে। কেবল ক্ষতিপূরণে নয়, পোশাক শিল্পের পরিকাঠামো সংস্কারেও এখন বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা যোগ দিতে উৎসাহী। ইহা সুলক্ষণ। ব্যবসায়িক স্বার্থ যখন মানবিকতার অনুকূলে কাজ করে, তখন তাহা নির্ভরযোগ্য হয়। |