শব্দটি সচরাচর শাস্তি অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহা কর্মফল শব্দের বিশেষ অর্থ। সাধারণ ভাবে কর্মের ফল কোনও নেতিবাচক ধারণা নয়। বহু সংস্থায় কর্মীদের যে বার্ষিক মূল্যায়ন হয়, যে মূল্যায়নের ভিত্তিতে তাঁহাদের প্রাপ্য নির্ধারিত হয়, তাহাও প্রকৃতপক্ষে কর্মফলের মূল্যায়ন। কোন কর্মী কেমন কাজ করিয়াছেন, তাহার ফল বিচার করিয়া তাঁহার প্রাপ্য বেতন, ভাতা, পদোন্নতি ইত্যাদি স্থির করিবার এই প্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব নৈর্ব্যক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত করিয়া তোলাই যথার্থ মানবসম্পদ পরিচালনার লক্ষ্য। স্বভাবতই, পুরস্কারের বিপরীতে থাকে তিরস্কার, পদোন্নতির বিপরীতে দায়িত্ব ছাঁটাই বা সংকোচন। ভাল কাজ করিলে উন্নতি হইবে আর ভাল কাজ না করিলে কিছুই হইবে না, ইহা নীতি হইতে পারে না। সাফল্য এবং ব্যর্থতা কর্মফল উভয়ত প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রশাসনের পরিচালনায় এই হিসাবটি অগ্রাহ্য করাই এ-যাবৎ দস্তুর ছিল। বামফ্রন্ট শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসে কর্মসম্পাদনে সাফল্যের পুরস্কার বা ব্যর্থতার শাস্তি কখনও দেখা যায় নাই, বস্তুত তাহার কোনও সম্ভাবনাও জাগ্রত হয় নাই। মন্ত্রিসভা তৈয়ারি হইত শরিকি সংসারের বিবিধ অঙ্ক কষিয়া। নানা দল, নানা গোষ্ঠী, নানা জেলা, নানা স্বার্থের দাবিদাওয়ার হিসাব মিলাইয়া দফতর বণ্টন হইত। কোন শরিক দলের হাতে কোন দফতর থাকিবে, তাহাও নির্দিষ্ট ছিল। স্থিতাবস্থাই এই রীতির অমোঘ পরিণাম। অতিদীর্ঘ রাজত্বের সুবাদে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সেই স্থিতাবস্থার এক চরম নজির হইয়া দাঁড়ায়। অদক্ষতা বা অপদার্থতা দূরস্থান, জরা এবং ব্যাধিজনিত চূড়ান্ত শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও মন্ত্রীরা মন্ত্রিত্বে অবিচল এই দৃশ্যই বহুলপ্রচলিত ছিল। এই অচলায়তন দেখিলে এস ওয়াজেদ আলি তাঁহার ‘ভারতবর্ষ’ নূতন করিয়া লিখিতেন।
পরিবর্তন সত্যই আসিয়াছে। নূতন বছরের পূর্বলগ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার মন্ত্রিসভার যে পরিবর্তন ঘোষণা করিয়াছেন, তাহা কেবল কয়েকটি নাম এবং দফতরের বদল নয়, তাহার মূলে রহিয়াছে নীতি এবং মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন। শিল্প মন্ত্রকের দায়িত্ব পার্থ চট্টোপাধ্যায় হইতে অমিত মিত্রের হাতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তটি এই পর্বান্তরের প্রকৃষ্ট প্রতীক। বঙ্গীয় সমাজে এই ধরনের সিদ্ধান্তকে সচরাচর ব্যক্তিগত অবস্থান বা ক্ষমতার উত্থানপতন হিসাবে দেখা হইয়া থাকে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অমিত মিত্র মুখ্যমন্ত্রীর কত কাছে ছিলেন, আছেন বা থাকিবেন, তাঁহাদের মানমর্যাদা বা দাপট কী অনুপাতে বাড়িবে বা কমিবে, এই সকল আলোচনাই এই সমাজে প্রচলিত। উহা চণ্ডীমণ্ডপের আলোচনা। প্রকৃতপক্ষে একটি বিষয়ই দেখিবার এবং বুঝিয়া লইবার। শিল্পমন্ত্রী হিসাবে পার্থবাবু প্রত্যাশিত তৎপরতা দেখাইতে পারেন নাই, সুতরাং এই গুরুত্বপূর্ণ দফতরটি হস্তান্তরিত হইয়াছে। অন্য দিকে, কেবল অর্থমন্ত্রী হিসাবে নয়, দেশের শিল্পবাণিজ্যের প্রথম সারির নায়কদের সহিত যোগাযোগ সাধনের জরুরি কাজটিতেও অমিত মিত্র যে দক্ষতা এবং নিষ্ঠা দেখাইয়াছেন, তাহার জোরেই তাঁহার ‘পদোন্নতি’। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের চশমা পরিয়া এই পরিবর্তনকে দেখিলে অবিচার হইবে। কেবল সিদ্ধান্তটির প্রতি অবিচার নয়, প্রশাসনিক কাঠামো পরিচালনায় প্রশাসকদের উদ্যম এবং কৃতিত্বকে মূল্য দিবার নূতন এবং অগ্রগামী মানসিকতার প্রতি অবিচার। যে মাপকাঠির সাহায্যে যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রীদের দক্ষতা যাচাই করিয়াছেন, তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিতেই পারে। এই মাপকাঠিগুলি উত্তরোত্তর উন্নততর করা হইবে, তাহাও প্রত্যাশিত। কিন্তু সে-সবই ক্রমিক অগ্রগতির প্রশ্ন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি অচলায়তনের গণ্ডি হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছেন। আশা করা যায়, কর্মফল-ভিত্তিক মূল্যায়নের এই মানসিকতা অতঃপর তাঁহার প্রশাসনের সর্ব ক্ষেত্রে সঞ্চারিত হইবে। |