প্রবন্ধ...
বিচার দুই প্রকার: ন্যায় এবং অন্যায়
খুরশিদ আনওয়ার আত্মহত্যা করলেন ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ। আচম্বিত কোনও ঘটনা নয়, দিল্লির এক এনজিওর অন্যতম কর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল কয়েক দিন আগেই। এনেছিলেন ওই এনজিওরই এক প্রাক্তন কর্মী। সাম্প্রতিক কালের আলোড়ন তোলা আরও কয়েকটি ঘটনার মতো এ ক্ষেত্রেও অভিযোগকারিণী সরাসরি পুলিশের কাছে যাননি। এক মহিলা অ্যাক্টিভিস্ট তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। অভিযোগটি পাঠানো হয় মহিলা কমিশনের কাছে। কমিশনের হস্তক্ষেপে পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। খবর ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। প্রত্যাশা মাফিকই আলোড়ন তৈরি হয়। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি জাতীয় টিভি চ্যানেলে ধর্ষক ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হয়। ‘বলাৎকারীকে তার গন্তব্যে পৌঁছে তবেই আমরা ছাড়ব’ আক্ষরিক ভাবে এই শব্দগুচ্ছ দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। এবং পরের দিন সকাল সাড়ে এগারোটায় তাঁর চারতলা ফ্ল্যাট থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েন খুরশিদ আনওয়ার। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই ধর্ষণের অভিযোগ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কোনও জায়গা পায়নি।
খুরশিদ আনওয়ারের মৃত্যুকে ‘মিডিয়া হত্যা’ আখ্যা দিয়ে এশীয় মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ক্ষেত্রে যাঁরা ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছিলেন, তাঁরা কখনওই পুলিশের কাছে যাননি, আইনি আদালতের কাছে নিয়ে যাবার জন্যও কোনও পদক্ষেপ করেননি। পরিবর্তে তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের এক অন্তহীন চক্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন যে, এমনকী এক জন অভিযুক্তেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে।’

শাস্তি, শাস্তি! ‘অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাই।’ কলকাতা, ডিসেম্বর। ছবি: পি টি আই।
খুরশিদ আনওয়ারের ঘটনা শুধু বেদনাদায়কই নয়, গুরুত্বপূর্ণও। কারণ, এশীয় মানবাধিকার কমিশনের এই পর্যবেক্ষণ শুধু খুরশিদ আনওয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। ভারতে সাম্প্রতিক কালের হাই-প্রোফাইল নারী-নির্যাতনের অভিযোগগুলির ক্ষেত্রে যা দেখা যাচ্ছে, মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষেত্রে ‘অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে’ এ কথাটা ভুলে যাওয়াটাই যেন সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলি নিয়ে মিডিয়ায় আলোড়ন, তার কোনও ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ভাবে অভিযোগকারীরা বা তাঁদের পরামর্শদাতারা সরাসরি আইনের আশ্রয় নেননি। বরং কোথাও কোনও ই-মেল ফাঁস করা হয়েছে, কোনও ব্লগ থেকে তুলে আনা হয়েছে অভিযোগ, সে নিয়ে আলোড়ন ও প্রচার মূলত শুরু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তার পর তা ছড়িয়ে পড়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। সেখানে এক রকম করে বসানো হয়েছে বিচারের আসর। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই জাতীয় মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে জেহাদ, প্রায় ফলাফল ঘোষণার ঢঙে। পুলিশ, আইন-আদালত এসেছে এই আইনবহির্ভূত বিচার প্রক্রিয়া এক রকম করে সম্পন্ন হওয়ার পর।
প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। যত ঘৃণ্য অভিযোগই হোক না কেন, অভিযুক্তের যে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে, নিজের বক্তব্য বলার আগেই জনতার আদালতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, পদ্ধতিগত ভাবে এর সঙ্গে খাপ পঞ্চায়েতের বিশেষ তফাত নেই, এই একটি বিশেষ বিষয়ে সেটা আমরা খেয়াল করছি না। মানবাধিকার বিষয়টিই এ ক্ষেত্রে নজর এড়াচ্ছে, সম্ভবত উৎসাহের কারণেই। যেটা আরও উদ্বেগজনক সেটা হল, এত দিন যে অ্যাক্টিভিস্টরা রাষ্ট্রের সমস্ত রকম নখ-দাঁত ওঁচানোর বিরুদ্ধে মানবাধিকারের এই সূত্রগুলি নিয়ে প্রান্তিকের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করতেন, তাঁরাই আজ টেবিলের উল্টো দিকে, অভিযোগকারীর ভূমিকায়। এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিশ্চুপ। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের কৃতকর্মকে নৃশংসতম আখ্যা দিয়েও তাঁর মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে দাঁড়ানোর লোকের অভাব হয়নি একটা সময়ে। কিন্তু দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে আইনি হেফাজতেই যখন অস্বাভাবিক ভাবে মারা যান এক জন অভিযুক্ত, লকআপে মেরে মুখ ফাটিয়ে দেওয়া হয় তাঁর, তখন সে-সব নিয়ে কোনও ঝড় ওঠে না। কারণ, সম্ভবত সবাই ভাবছেন যে, ‘বেশ হয়েছে’। সম্ভাব্য প্রতিবাদীরাও সকলেই সঙ্গত কারণেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে। তাঁরাও বোধহয় সেই ‘বেশ হয়েছে’ ভাবনারই অংশীদার। ফলে অভিযুক্তের অধিকার নিয়ে বলার লোক আর নেই।
এটা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। অপরাধ যতই নৃশংস হোক, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পিছনে যতই মহৎ আদর্শ বা যৌক্তিক দাবিদাওয়া থাকুক, তাতে করে অপরাধীর অধিকার চলে যায় না। অপরাধের বিরুদ্ধে বলা আর অপরাধীর অধিকারের পক্ষে বলা, এ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এ সব আমরা জানি। নৃশংসতম অপরাধের ক্ষেত্রেও অভিযুক্তের মানবাধিকার আছে, বিচারের আগেই পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু কোনও অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না, সে-ও আমাদের অজানা নয়। তা হলে এই বিস্মরণ কেন? আমরা নিজেরা অভিযোগকারীর দলে বলে? বিচারের পরে অভিযুক্তের কঠোরতম সাজা-ই হত, সেটা কাম্যও, কিন্তু তার আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এই নীরবতা কেন? চটজলদি বিচারের আশায়?
দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ড একটি ভয়াবহতম ঘটনা। তার অভিঘাতে আমরা সকলেই নড়েচড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে নীরবতার অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে। চটজলদি বিচার চাইবার পক্ষে যুক্তিও থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়টা ওখানেই তো শেষ হচ্ছে না, এই চটজলদি বিচার সেরে ফেলার আকাঙ্ক্ষা সর্বত্র। তুলনায় অনেক কম নৃশংস অভিযোগগুলির ক্ষেত্রেও সেই একই আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। অভিযোগ ওঠা মাত্র, পুলিশের কাছে যাওয়ার আগেই সেরে ফেলা হচ্ছে সংক্ষিপ্ত বিচার। এবং প্রভাবশালী পোড়-খাওয়া অ্যাক্টিভিস্টরা অনেক ক্ষেত্রেই তাতে প্রত্যক্ষ ভাবে বা চুপচাপ থেকে পরোক্ষে স্বীকৃতির ছাপ দিচ্ছেন। এ নিয়ে কোনও রাখঢাক নেই, কোথাও টিভি চ্যানেলে বসছেন রায়দানকারীরা, কোথাও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল নিজেই ফাঁস করে দিচ্ছেন গোপন জবানবন্দি। ভঙ্গিটা একই, যে, বিচার-টিচার খুবই ঝামেলার, আসুন এখানেই শেষ করে ফেলি সব। সবই চটপট জনতার আদালতে কর্ম সেরে ফেলার তাড়না।
এই প্রক্রিয়াটি যে অতীব গোলমেলে, সে আমরা জানি। এর দায়, নিঃসন্দেহে, অনেকাংশেই প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ঢিমে-তেতালার। এখানে তদন্ত হতে মাস গড়ায়, অপরাধীদের আদৌ চার্জশিট দেওয়া হবে কি না কেউ জানে না, শুনানি শেষ হতে বছর গুনতে হয়, আর অন্তিম ফললাভ হতে যুগাবসান হতে পারে। প্রশাসনের এই শ্লথগতি, এবং অনেক সময় প্রভাবশালী অপরাধীকে আড়াল করার যে প্রবণতা, তার বিরুদ্ধে বৈদ্যুতিন এবং সামাজিক মিডিয়া একটি শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে, এবং হয়েছেও। জেসিকা লাল হত্যা মামলার কথা আমরা ভুলে যাইনি। সেখানে ‘মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’-র ঢঙে তদন্তের খাতা বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। তার পরে মিডিয়া আর জনতার চাপে সেই কেস পুনর্বার কী ভাবে খোলা হয়, সে এখন ইতিহাস। কিন্তু জেসিকা লাল কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি আর হচ্ছে না (হলে সেটা খুবই আনন্দদায়ক হত)। আজকের মিডিয়ার ভূমিকা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। জেসিকা লাল কাণ্ডে অপরাধের বিচার করতে মিডিয়া সরাসরি এগিয়ে আসেনি। সে কাজ ছিল পুলিশেরই হাতে। পুলিশের কাজের জন্য অপেক্ষা করা হয়েছিল, সে কাজে পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার পরে, মিডিয়া এবং জনমত চাপ তৈরি করে তদন্ত ও বিচার করার জন্য। আজকের মিডিয়ার এত ধৈর্য নেই। সে আদৌ পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছে না। পুলিশে আদৌ অভিযোগই করা হচ্ছে না। সামাজিক মিডিয়ায় খবর ছড়াচ্ছে দ্রুত, প্রতিযোগিতার দাপটে বৈদ্যুতিন মিডিয়াও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে খবরকে চটজলদি সেনসেশনে পরিণত করে ফেলার চাপে পড়ছে, ঝটপট শেষ করে ফেলা হচ্ছে তদন্ত এবং বিচার, পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য অপেক্ষা না করেই।
এর পুরোটাই প্রতিযোগিতার তাড়না কি না, সে নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। এর পিছনে কোনও মহৎ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। কিন্তু সব মিলিয়ে, যত মহৎ উদ্দেশ্যের জন্যই করা হোক না কেন, এমনকী নারী বা প্রান্তিকের পক্ষে বলা হলেও, এই চটজলদি বিচার প্রক্রিয়া এক ধরনের ক্যাঙারু কোর্টেই রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ভাবেই চটজলদি বিচারের আশায়ই একদল মানুষ চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে ফেলে আর একজন মানুষকে, যাকে আমরা গণপিটুনি বলি। সমস্যার গভীরে নজর দেওয়ার বদলে এ শুধু চটজলদি কিছু মুণ্ডু কেটে নেবার পদ্ধতি। হিংসার জবাবে আর এক দফা প্রতিহিংসা। অন্তহীন চক্রে পুরো ন্যায়বিচার ব্যাপারটিই ক্রমশ উহ্য হয়ে যেতে পারে এ রকম আশঙ্কা হয়। আশঙ্কা হয়, এক দিকে রক্তের মধ্যে গড়াবে ধর্ষণে অভিযুক্ত খুরশিদ আনওয়ারের লাশ, আর অন্য দিকে দু-একটি হাই-প্রোফাইল কেসের সাফল্যের নীচে চাপা পড়ে থাকবে প্রান্তিক ইটভাটার শ্রমিক কিংবা গৃহসহায়িকাদের দৈনন্দিন যৌন নিগ্রহ।
তবে উপপ্লবের পর বোধহয় এমনই হয়। টেল অব টু সিটিজ-এর শেষ দৃশ্যের মহিলারা শান্ত মনে উল বুনতে বুনতে কাটা মুণ্ডু গোনেন। নির্ভয়া কাণ্ডের মিছিলে নামা দুই কর্মীর এক জন ধর্ষণের অভিযোগ আনেন আর এক জনের বিরুদ্ধে, আর মিডিয়া-বিচারের শেষে, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি লাশ হয়ে পড়ে থাকেন নিজের ফ্ল্যাটের নীচে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.