দমদমে এক পানশালায় এক যুবকের মৃত্যু প্রসঙ্গে দমদম থানার পুলিশ মন্তব্য করিয়াছে: সেই পানশালায় নাচগান চলিত, তাহা নাকি পুলিশের জানা ছিল না! জ্যোতি বসু প্রীত হইতেন— অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এড়াইতে অজ্ঞানতার অজুহাত ব্যবহার করিবার ঐতিহ্যটি সমানে চলিতেছে। তবে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী না জানিবার ভান করিলেও করিতে পারেন, থানার আধিকারিকের সেই বিলাসিতার উপায় নাই। তাঁহার কাজই হইল জানা। তাঁহার এলাকায় কোথায় কী চলিতেছে, কোথাও আইন ভাঙা হইতেছে কি না, এই খবর রাখাই তাঁহার চাকুরির অঙ্গ। আধিকারিকপ্রবর স্পষ্টতই সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ। প্রশ্ন হইল, তাঁহাকে কেন ওই পদে বসাইয়া রাখা হইবে? দায়িত্ব পালনে তাঁহার যখন মন নাই, অথবা সেই ক্ষমতা নাই, তখন পুলিশের উর্দিতে তাঁহার অধিকারও নাই।
তবে অনুমান করিবার কারণ আছে, এই ‘অজ্ঞানতা’ নেহাতই পিঠ বাঁচাইবার পন্থা। এলাকার কোনও বেনিয়মই যে থানার অজ্ঞাতসারে হয় না, এমন অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গে নূতন নহে। ফুটপাথে বেআইনি হকার হইতে বাড়তি যাত্রিবাহী অটো রিকশা, প্রতি ক্ষেত্রেই নাকি পুলিশের সহিত মাসকাবারি বন্দোবস্ত থাকে। অভিজ্ঞ জনেরা বলেন, নির্দিষ্ট কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে চোখ ফিরাইয়া থাকাই পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের দস্তুর। দমদমের পানশালার ক্ষেত্রেও সেই স্বেচ্ছা-অজ্ঞানতার ব্যত্যয় হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না। সেই পানশালায় গানবাজনার অনুমতি ছিল কি না, তাহা তদন্তসাপেক্ষ। পুলিশের ভাব দেখিয়া সংশয় হয়, ছিল না। পানশালার অন্দরমহলের হল্লা এবং বিশৃঙ্খলা পথে নামিয়া মাঝেমধ্যেই স্থানীয় মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করিত। পুলিশ সেই অভিযোগে কর্ণপাত করে নাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কর্তব্য, এই পানশালার ঘটনাটিকে একটি কড়া বার্তা পাঠাইবার কাজে ব্যবহার করা। কর্তব্যে অবহেলা করিয়া যে পার পাওয়া যাইবে না, এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝাইয়া দেওয়া প্রয়োজন।
এইখানেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সহিত রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্নটি জড়াইয়া যায়। শাসক দলের প্রত্যক্ষ সম্মতি ছাড়া পুলিশ কুটাটিও নাড়ে, পশ্চিমবঙ্গে এমন কথা বলিবার সুযোগ বেশ কয়েক দশক যাবৎ নাই। বরং নিন্দুকে বলিয়া থাকে, থানায় থানায় যে মাসকাবারি টাকা জমা পড়ে, তাহার একটি হিস্যা আগেও পার্টি অফিসে পৌঁছাইত, এখনও পৌঁছয়— পার্টি বদলাইয়াছে, প্রক্রিয়া বদলায় নাই। কাজেই, প্রশ্নটি শুধু পুলিশকে কড়া বার্তা দেওয়ার নহে। যে কারণে পুলিশ আজ এই অতলে নামিয়াছে, সেই কারণটির মূলোচ্ছেদ না করিতে পারিলে কিছুতেই কোনও লাভ হইবে না। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি অনেকগুলি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। তিনি হয়তো সত্যই এই দুষ্টচক্র ভাঙিতে চাহেন। কিন্তু, সরকারি কর্মীদের কাজে মন দিতে বলা এক কথা, পুলিশের দুর্নীতি দমন আর এক। দ্বিতীয় কাজটি অনেক বেশি কঠিন। ইহাই প্রশাসক হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরীক্ষা। তাঁহাকে প্রমাণ করিতে হইবে, তিনি প্রথমে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, পরে দলনেত্রী। পুলিশের আমূল সংস্কার চাই। তাহার জন্য দলীয় স্বার্থে ঘা পড়িলে পড়িবে। কিন্তু, পুলিশের উর্দি যে নিছক ঘুষ খাইবার ছাড়পত্র নহে, কর্তব্যপালনের দায়বদ্ধতা, এই কথাটি স্মরণ করাইয়া দিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ আত্মসম্মান হারাইয়াছে। তাহা ফিরাইয়া আনিতে হইবে। তাহার জন্য যত কঠোর হওয়া প্রয়োজন, হইতে হইবে। তাহাই প্রশাসন নামক দায়িত্বটির অন্যতম প্রধান শর্ত। |