সম্পাদকীয় ১...
উল্টো রথ
কালতি যাঁহাদের পেশা, বাংলায় তাঁহাদের ব্যবহারজীবী বলা হয়। আভিধানিক অর্থে ‘ব্যবহার’ আইনের অন্যতম প্রতিশব্দ। প্রয়োগের বিচারে শব্দটি জানাইয়া দেয়, উকিলরা আইন ব্যবহার করিয়া জীবিকা অর্জন করেন। আইন তাঁহাদের নিকট ব্যবহারের উপকরণ। আইনের ব্যবহারিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রযুক্তি যেমন বিজ্ঞান নয়, ব্যবহারিক আইন তেমনই আইন-বিজ্ঞান হইতে স্বতন্ত্র। লক্ষণীয়, ইংরেজিতে ‘ল’ এবং ‘জুরিসপ্রুডেন্স’ দুইটি শব্দ কেবল ভিন্ন নয়, ভিন্ন গোত্রের বা স্তরের। জুরিসপ্রুডেন্স বা আইন-বিজ্ঞান আইনের মূল নীতি এবং ধর্ম সম্পর্কিত বিদ্যা। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান যেমন ব্যবহারিক প্রযুক্তির উৎস, আইন-বিজ্ঞান তেমনই ব্যবহারিক আইনের। আইনজীবীদের এই সূক্ষ্ম পার্থক্য লইয়া চিন্তিত হইবার কারণ ঘটে না, তাঁহাদের নিকট সেই সূক্ষ্মবিচার প্রত্যাশিতও নহে। কিন্তু আইন-তত্ত্ব শিখাইবার জন্য যে প্রতিষ্ঠান তৈয়ারি হইয়াছে, আইন-দর্শনের চর্চার জন্য যাহার প্রসিদ্ধি, তেমন একটি শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক তথা শিক্ষকরা এই বিষয়ে সতর্ক থাকিবেন, ইহা প্রত্যাশিত।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস (এন ইউ জে এস) এই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। এক ছাত্রীর যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের সহিত ‘সাময়িক ভাবে’ সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত লইয়া এন ইউ জে এস ভারতীয় আইন এবং বিচারব্যবস্থার আদর্শ অমান্য করিয়াছে। সেই আদর্শ বলে: অপরাধ যতক্ষণ প্রমাণিত না হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি ততক্ষণ আইনের চোখে নিরপরাধ। অশোকবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার যতক্ষণ সম্পন্ন না হয়, ততক্ষণ তিনি অভিযুক্তমাত্র। এই অভিযোগকেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করিয়া এন ইউ জে এস বা মানবাধিকার কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ হইতে স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে সরিয়া দাঁড়ানো তাঁহার উচিত ছিল কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু বিচারের আগেই তাঁহাকে কার্যত অপসারণ করা হইতেছে, ইহা অন্যায়।
এই অন্যায়ের উৎস আইনের মূলেই। প্রমাণের আগে অবধি অভিযুক্তকে নিরপরাধ গণ্য করিবার যে আদর্শটি ব্রিটিশ আইন-দর্শন হইতে এ দেশে গৃহীত, মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বা লাঞ্ছনার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে তাহাকে যথেষ্ট মান্য করা হয় নাই। সমাজের চাপে, বিশেষত দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের পরে প্রবল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের চাপে নীতিকাররা সেই আদর্শকে কার্যত বিসর্জন দিয়াছেন। নারীর বিরুদ্ধে হিংসার প্রতিকারে কঠোরতর আইন নিশ্চয়ই আবশ্যক ছিল। কিন্তু সেই কঠোরতাকে যেন ‘জনতার আদালত’-এ শাস্তিদানের ছাড়পত্র বলিয়া গণ্য করা হইতেছে। ইহা কেবল আইন-দর্শনের ধর্মবিরোধী নহে, ইহা স্বাভাবিক ন্যায়েরও বিরোধী। অত্যাচারিতের যেমন ন্যায় পাইবার অধিকার আছে, অভিযুক্তেরও সেই অধিকার তেমনই প্রাপ্য। বস্তুত, অত্যাচারিতের নাম-পরিচয় গোপন রাখিবার নীতি যেমন যুক্তিসংগত, বিচার চলাকালীন অভিযুক্তের নাম-পরিচয় গোপন রাখার পক্ষেও তেমনই যথেষ্ট যুক্তি আছে। অথচ অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘটনাটিই দেখাইয়া দেয়, সম্পূর্ণ বেলাগাম উৎসাহে ‘গণ-বিচার’ চলিতেছে, প্রবীণ কেন্দ্রীয় সরকারি আইনজীবী অবধি সেই বিচারে শরিক! জনসমক্ষে অভিযুক্ত, নিন্দিত ও লজ্জিত করিয়া বিচার সারিবার রীতিটি প্রাচীন সমাজে প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ আইন-দর্শনের সতর্কতা সেই প্রাচীন অন্যায় হইতে সভ্যতায় উত্তরণের অন্যতম শর্ত হিসাবেই সম্মাননীয়। অন্য ধরনের— যথা ফ্রান্সের— আইন-দর্শন ‘অপরাধ প্রমাণ না হওয়া অবধি নিরপরাধ’-এর তত্ত্ব নীতি হিসাবে মানে না, কিন্তু স্বাভাবিক ন্যায়ের দাবি মানিয়া লইয়া বাস্তবে সেখানেও অভিযুক্তের অধিকার উত্তরোত্তর সম্মানিত হইতেছে। ‘মেয়েদের সমস্যার সমাধান’ করিতে গিয়া ভারত কি উল্টো পথে হাঁটিবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.