ঘরের ভেতরে জোড়া লাগানো দু’টি চৌকির মধ্যিখানে গরম জামাকাপড় পরে শুয়ে বছর দেড়-দুইয়ের এক শিশুকন্যা। তার মাথার পাশে ভাগবত গীতা। চৌকির অন্য প্রান্তে পাশ ফিরে শুয়ে বছর সাতের এক বালিকা। পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে মাঝবয়সী মহিলা। নীচে মেঝেতে চৌকির পাশে জড়াজড়ি করে শুয়ে এক কিশোরী ও বালিকা। দূরেই পড়ে বছর পঁয়তাল্লিশের এক ব্যক্তি।
প্রত্যেকেই নিষ্প্রাণ।
বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় একটি আশ্রমের অতিথি নিবাসের ঘরে একই পরিবারের ছয় সদস্যের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়াল তারাপীঠে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, কীটনাশক খেয়ে চার মেয়েকে নিয়ে দম্পতি আত্মঘাতী হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘর থেকে পাওয়া ভোটার ও প্যান কার্ড এবং আশ্রমের রেজিস্টার থেকে দম্পতির পরিচয় মিলেছে। মৃত বিজয়শঙ্কর মিশ্র (৪৫) ও তাঁর স্ত্রী কালিন্দী মিশ্র (৪২) আদতে গুজরাতের সুরাত জেলার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে থাকতেন বিহারের পটনা জেলার খেমানি চকে। পুলিশ ওই ঘর থেকে একটি সুইসাইড নোটও উদ্ধার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, হিন্দিতে লেখা ওই নোটে আর্থিক দুরবস্থার কারণে আত্মহত্যার কথা লেখা রয়েছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, এটি আত্মহত্যারই ঘটনা। খাবারে বিষ মিশিয়ে না অন্য কোনও ভাবে হয়েছে, তা ময়না-তদন্তের রিপোর্ট এলেই বোঝা যাবে।” ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া একটি মোবাইল ফোনের সূত্রে বিহারে থাকা ওই পরিবারের কয়েক জন আত্মীয়ের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করেছে। তাঁরা তারাপীঠের দিকে রওনা দিয়েছেন। |
আশ্রম সূত্রে খবর, মঙ্গলবার সকালে ওই দম্পতি তাঁদের চার মেয়েকে (প্রত্যেকের বয়স ৭-১৪) নিয়ে দু’দিন থাকার জন্য আশ্রমের ১৬ নম্বর ঘরটি ভাড়া নেন। পটনার খেমানি চকের বাসিন্দা জানিয়ে কালিন্দী মিশ্র নামে ওই বধূ রেজিস্টারে নিজের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন। অসম্পূর্ণ ঠিকানা দেওয়া ছাড়াও রেজিস্টারে তিনি কোনও মোবাইল নম্বরও দেননি। এ দিন সকালেই ওই পরিবারের ঘর ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেই মতো সকাল ন’টা নাগাদ ‘চেক আউটে’র জন্য আশ্রমের কর্মীরা ওই ঘরে যান। কিন্তু বার কয়েক দরজায় কড়া নেড়েও কোনও সাড়া মেলেনি। দরজা ঠেলতেই তাঁরা বুঝতে পারেন দরজাটি ভেতর থেকে বন্ধ করা নেই। ভেজানো দরজা আলতো করে ঠেলতেই ঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখে কর্মীরা শিউড়ে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। আশ্রমের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক বলেন, “দম্পতি জানিয়েছিলেন, তারাপীঠে দু’ দিন থেকে পূজা-পাঠ করে চলে যাবেন। এ ভাবে অনেকেই পরিবার নিয়ে আশ্রমে আসেন। আমাদের তেমন সন্দেহ হয়নি। তাই আলাদা করে ওঁদের আর পরিচয়পত্র দেখা হয়নি।” তাঁর দাবি, ওই বধূর কাছ থেকে পরিবারের বাকি সদস্যদের নাম ও মোবাইল নম্বর রেজিস্টারে দিতে বলা হলে তিনি পরে জানিয়ে যাবেন বলে চলে যান। পরে অবশ্য তা আর মেলেনি। ওই আধিকারিক বলেন, “রাত ন’টার দিকে ভদ্রলোক অফিস থেকে গায়ে দেওয়া চাদর নিয়ে গিয়েছিলেন। তখনও তাঁর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক আচরণ আমরা খেয়াল করিনি।”
দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, আশ্রমের ভেতরে-বাইরে কৌতূহলী জনতার ভিড়। এসডিপিও (রামপুরহাট) কোটেশ্বর রাও তদন্ত শুরু করেছেন। একটু আগেই ঘরটির দরজা খোলা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে পুলিশ দরজায় শিকল তুলে দিয়েছে। ভেতরে মৃতদেহগুলি তখনও একই অবস্থায় পড়ে। কিছু ক্ষণ পরে দেহগুলি ময়না-তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বলে পুলিশ ফের ঘরের দরজা খুলল। দেখা গেল এই প্রবল শীতেও ঘরের পাখা চলছে। কীটনাশকের গন্ধও ভেসে এল। ভেতরেই মিলল কীটনাশকের একটি ছোট বোতল। ভোটার কার্ড ও প্যান কার্ডও উদ্ধার হল। ঘরের ভেতরে থাকা একটি ব্যাগ থেকে পুলিশ হরিদ্বারের একটি ধর্মশালার স্লিপ পেয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে পরিবারটি গত ২৫-২৬ নভেম্বর ওই ধর্মশালায় উঠেছিল। সুইসাইড নোটটি পাওয়া যায় বিছানায় পড়ে থাকা একটি গীতার পাশ থেকে। হিন্দিতে লেখা সুইসাইড নোটে লেখা হয়েছে, ‘আমার ধন দৌলত নেই। এই পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মা তুমি আমাকে গ্রহণ কর।’
এ দিন রাতে কোটেশ্বরবাবু বলেন, “ভোটার কার্ডটিতে গুজরাটের সুরাত জেলার পাণ্ডেসারা শহরের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। ভোটার কার্ডটি ইস্যু হয়েছে বিজয়শঙ্কর মিশ্রের নামে। তবে মোবাইল ফোনের সূত্রে আমরা জানতে পারি ওই পরিবারটি বর্তমানে পটনার খেমানি চক এলাকায় থাকতেন। আমরা ইতিমধ্যেই তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি।” এ দিকে, তারাপীঠের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্রে পরিচয়পত্র না দেখে অসম্পূর্ণ ঠিকানা দেখিয়ে ঘরভাড়া পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ যদিও ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কড়া হবেন বলে জানিয়েছেন। এসপি বলেন, “এ ব্যাপারে সবাইকে বহু বার সতর্ক করা হয়েছে। আশা করছি, এর পর থেকে সবাই আরও বেশি সতর্ক হবেন।”
|