আইন বলছে, দিতে হবে বাসযোগ্য ঘর। বাস্তবে, একটি পরিবার বাস করে চার ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের প্রায় বর্গাকার একটি ঘরে। রান্না-খাওয়াও সেখানেই।
আইন মোতাবেক, শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অভিযোগ, কোনও রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। অসুস্থ হলে মালিকপক্ষ হাসপাতালে পৌঁছে দেন। তার পরে আর খোঁজ নেন না।
নিয়ম অনুযায়ী, শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে, স্কুলে যাওয়ার বদলে শিশুরা দিনভর কাজ করে বাবা-মায়ের সঙ্গে।
শীতে দেওয়ার কথা উপযুক্ত পোশাক। আদতে, ছেঁড়া-ময়লা জামাকাপড় পরেই দিন গুজরান শ্রমিকদের।
আসানসোল মহকুমার নানা ইটভাটায় এমন পরিস্থিতিতেই কাজ করেন শ্রমিক-কর্মীরা। সম্প্রতি এ রকম বেশ কয়েকটি ইটভাটা পরিদর্শন করেন আসানসোল-দুর্গাপুরের ডেপুটি লেবার কমিশনার পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী। ঘুরে দেখে তিনিও মনে করছেন, লঙ্ঘিত হচ্ছে শ্রম আইন। |
আসানসোলর ডামরা এলাকার ইটভাটার একটি আবাসন। |
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, আসানসোল মহকুমা জুড়ে ১২১টি বৈধ ইটভাটা রয়েছে। প্রতিটিতে গড়ে ১২৫ জন করে কাজ করেন। অধিকাংশ শ্রমিকই আসেন পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের নানা গ্রাম থেকে। মালিকেরা ইটভাটা চত্বরেই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। কাঁচা ইটের দেওয়াল ও হোগলার ছাউনি দেওয়া ঘুপচি ঘর। তাতে বাস করেন গড়ে পাঁচ জন। ঘরের এক কোণেই উনুন ধরিয়ে রান্নাবান্না। অন্য দিকে খড় বিছিয়ে বিছানা। ঝাড়খণ্ড থেকে কাজ করতে আসা গণেশ সিংহের অভিযোগ, “ছোট ঘরে থাকতে থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসে। কত বার বলেছি, বড় ঘর তৈরি করে দিতে হবে। কেউ কানে তোলেনি।” রাঁচির ক্ষেতুরা ওরাং বলেন, “পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। এঁদো পুকুর ও কুয়োর জল ভরসা।” মধুপুরের বুধেশ্বর টুডুর অভিযোগ, “শরীর খারাপ হলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দিয়ে আসেন মালিকেরা। আর কোনও দায়িত্ব পালন করেন না।”
আসানসোল-দুর্গাপুরের ডেপুটি লেবার কমিশনার পার্থপ্রতিমবাবু জানান, ‘ইন্টার স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন্স অ্যাক্ট ১৯৭৯’ অনুসারে ভিন্ রাজ্য থেকে ইটভাটায় কাজ করতে আসা শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা দেওয়ার কথা বলা আছে। তার মধ্যে রয়েছে বাসযোগ্য ঘর, ন্যূনতম চিকিৎসা, শিশুদের পড়াশোনা ও টীকাকরণের ব্যবস্থা। ইটভাটাগুলিতে এ সব মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছেন পার্থপ্রতিমবাবু। তিনি জানান, শ্রম দফতরের নিয়মকানুন প্রায় মানছেনই না ইটভাটা মালিকেরা। তিনি বলেন, “আমাদেরও কর্মী কম আছে। নিয়মিত অভিযান চালানো যায় না। সেই সুযোগেই ইটভাটা মালিকেরা শ্রম আইন লঙ্ঘন করছেন। আমরা কিছু ভাটা প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করছি। তাদের শো-কজের নোটিস পাঠাব।” তিনি আরও জানান, এ রাজ্যে এই ধরনের অসংগঠিত শ্রমিক-কর্মীদের জন্য বেশ কিছু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে। কিন্তু সমস্যা হল, ইটভাটা শ্রমিকেরা স্থায়ী ভাবে বাস করেন না। কয়েক মাস পরে তাঁরা গ্রামে ফিরে যান। তাই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির সুবিধা পান না। পার্থপ্রতিমবাবু বলেন, “নিয়মিত ভাবে এলাকা ভাগ করে ইটভাটাগুলিতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।” |
একই ঘরে চলে শোওয়া, রান্না, খাওয়া, সবই। |
ইটভাটায় ভিন্ এলাকা থেকে আসা এই সব অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কোনও আন্দোলন করে না শ্রমিক সংগঠনগুলি। আইএনটিইউসি-র জেলা সম্পাদক চণ্ডী চট্টোপাধ্যায় জানান, অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে তাঁরা সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভেবেছেন। কিছু সমস্যা থাকায় এখনও তা হয়নি। সিটু নেতা সুজিত ভট্টচার্যের আবার দাবি, এই সব ইটভাটার শ্রমিকেরা কাজ হারানোর ভয়ে কিছুতেই মালিকের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চান না। তাই সংগঠন গড়তেও ভয় পান। ফলে, সংগঠনের নেতারাও আন্দোলনে নামতে পারেন না।
মহকুমার ইটভাটাগুলিতে শ্রমিকদের খারাপ পরিবেশে থাকতে হয়, এই অভিযোগ মালিকেরা মানতে নারাজ। ডামরা এলাকার এক ভাটা মালিক ময়ূর মাজির দাবি, “পর্যাপ্ত জায়গা নিয়েই আবাসন বানিয়েছি। অন্য সুবিধাও দিয়েছি।” কুলটির বড়িরা গ্রামের ইটভাটা মালিক বিবেক ঘোষ আবার বলেন, “শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ চালাই। অসুস্থ হলে চিকিৎসাও করাই।” আসানসোলের বকবাঁধ এলাকার ভাটা মালিক সুভাষ মণ্ডলের বক্তব্য, “ইটভাটার দূষণ থেকে শ্রমিকদের রক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছি।” যদিও এই তিন ইটভাটাতেই গিয়ে দেখা গিয়েছে, ঘুপচি ঘরেই বাস। শিশুদের পড়াশোনা বা চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই।
আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস অবশ্য জানান, ইটভাটাগুলিতে শ্রমিকদের দুরবস্থার ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে মাঝে-মাঝে নানা ইটভাটায় বেআইনি কাজের অভিযোগ এসেছে। সে ক্ষেত্রে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানান অমিতাভবাবু। |