বিল মিটিয়ে আলো ফেরালো সান্তা ক্লজ।
কুষ্ঠরোগীদের ছেলেমেয়েদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিদ্যুতের বিল বকেয়া থাকায় সংযোগ কেটে দিয়েছিল বিদ্যুৎ বণ্টন দফতর। চাঁদা তুলে বকেয়া বিলের প্রায় পুরোটা মিটিয়ে বড়দিনের আগে পুরুলিয়ার আদ্রার ওই বেসরকারি হোমে আলো ফেরালেন স্থানীয় মণিপুর গ্রামের বাসিন্দারা। এক সপ্তাহ অন্ধকারে কাটানো হোমের বাসিন্দা দেড়শো কিশোর-কিশোরীর কাছে তাঁরাই এখন সান্তা ক্লজ।
মণিপুর গ্রামে গত ৩০ বছর ধরে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজ করছে ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কুষ্ঠরোগাক্রান্ত বয়স্কদের জন্য একটি বৃদ্ধাবাস রয়েছে। পাশেই রয়েছে কুষ্ঠরোগীদের ছেলেমেয়েদের হোম ‘অরুণোদয় শিশু নিকেতন’। ওই হোমে থেকেই এলাকার স্কুলে পড়াশোনা করে ছেলেমেয়েরা। তাদের মধ্যে প্রায় ৯৫ জন হাইস্কুলে পড়ে। হোমের আবাসিকদের মধ্যে এ বার কয়েকজন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। একই চত্বরে রয়েছে বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়া বাচ্চাদের জন্য একটি ‘শর্ট-স্টে হোম’।
সরকারি অনুদানেই ‘মণিপুর লেপ্রসি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার’-এর কাজ চলে। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, নানা জটিলতায় তাঁরা গত এক বছর সরকারি অনুদানের ২০ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা পাননি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রথম তিন মাসের জন্য সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক সমাজকল্যাণ দফতর পাঠালেও, তাতে ট্রেজারির নামে গণ্ডগোল থাকায় চেকটি ভাঙানো যায়নি। সংশোধিত চেকও তাঁদের হাতে আসেনি। |
প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক নবকুমার দাস বলেন, “অনুদান না পাওয়ায় আবাসিকদের থাকা-খাওয়া-সহ অন্য পরিষেবা দিতে প্রাণান্তকর অবস্থা হচ্ছে। ধার-দেনা করে চলছে। বিদ্যুৎ দফতরের কাছে প্রায় ৫২ হাজার টাকার বিল বকেয়া ছিল। তারা কিছু দিন আগে পড়ুয়াদের হোমের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়ে যায়। বাচ্চাদের স্কুলের ফি-ও বাকি পড়েছে।”
পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সবুজবরণ সরকার বলেন, “ওই হোমের অনুদান নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে কিছু সমস্যা হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটির বৈঠকে কথা হয়েছে। রাজ্যের কাছে অনুদানের টাকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে।”
এক সপ্তাহ আগে হোমের বিদ্যুৎ সংযোগ কাটা পড়ার পরে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতে হয়েছে পড়ুয়ারা। হ্যারিকেনপিছু তিন-চার জন। তা-ও খুব বেশিক্ষণ নয়। কারণ, কেরোসিন ছিল বাড়ন্ত। তাদের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মিলন মাহাতো, দীপক কালিন্দী, পুজা লোহার বলে, “বিদ্যুৎ থাকলে আমরা গভীর রাত পর্যন্ত পড়ি। হ্যারিকেনের আলোয় ঘণ্টা দু’য়েক পড়ার পরেই ক্ষান্ত দিতে হত। দেখতাম, আশপাশের বাড়িতে আলো। আমরা অন্ধকারে।”
দীপক, পুজাদের সহপাঠীদের কাছ থেকে হোমের এই সমস্যার কথা জানতে পারেন গ্রামবাসী। তাঁরা জানান, এলাকায় এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যাদের পূর্বপুরুষেরা কুষ্ঠ আক্রান্ত হয়ে এক সময়ে চিকিৎসা করাতে মণিপুর গ্রামে এসেছিলেন। সুস্থ হয়ে তাঁরা এখানেই বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী দিলীপ রায়, রঞ্জিত তাঁতি, শ্রীকান্ত সিংহ, অরুণা জানা, রেখা রায়দের কথায়, “রোগের জন্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ছোট ছেলেমেয়েরা অন্ধকারে দেখে খারাপ লাগছিল। তাই চাঁদা তুলতে শুরু করি।”
গ্রামবাসী এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা তুলে হোম কর্তৃপক্ষকে দেন। বাকি টাকা মিলিয়ে হোম কর্তৃপক্ষ জমা দেন বিদ্যুৎ দফতরে। বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার আদ্রার স্টেশন ম্যানেজার অনির্বাণ পাল বলেন, “তিন মাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ছিল ওই হোমের। কিছু দিন অপেক্ষার পরে বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ কাটতে হয়েছিল।”
বড়দিনের আগে আলো আসায় হোমে উজ্জ্বল মুখের সারি। তৃতীয় শ্রেণির নিকিতা মাহাতো, চতুর্থ শ্রেণির মৌসুমী হাঁসদারা বলছে, “সান্তা ক্লজ আলো ফিরিয়েছে আমাদের জন্য।” |