সম্পাদক সমীপেষু ...
যাত্রা ‘করে ফেলা’ মোটেই সহজ কথা নয়
‘চিৎপুর চিত্র’ (রবিবাসরীয়, ১-১২) পড়লাম। বাংলার পরম আদরের আদি লোকশিল্প ছিল এক সময় যাত্রাশিল্প। আজও কয়েক লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ভালবাসা আর জীবিকার টানে। অথচ নেহাত বিজ্ঞাপন ছাড়া এর কোনও অস্তিত্ব তো টের পায় না আজকালকার মানুষজন।
অভিনয়জীবনের দীর্ঘ দশ বছর এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। যাত্রাশিল্প শুধু আমার পেশা নয়, ছিল প্যাশন-প্রেম। শুধুমাত্র কিছু বেশি রোজগারের তাগিদে যাত্রাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল আশির দশকের গোড়া থেকেই। আজও সেই স্রোত বহমান। কিন্তু আসল গলদ আরও গোড়াতে। সবাই এখান থেকে কিছু নিয়ে যেতে চেয়েছে। আর যাত্রা অকৃপণ হাতে দিয়েছে। তাতে কি যাত্রা সমৃদ্ধ হয়েছে? কতিপয় প্রযোজক অবশ্যই কমবেশি সমৃদ্ধ হয়েছেন, সেই সব শিল্পীর পরিচিতিকে বিক্রি করে। এই ফাটল ধরেই কখন যে যাত্রা থেকে তার অভিনয়, তার নিজস্ব শৈলী ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হল, কেউ ফিরেও দেখল না। তৈরি হল না যাত্রার প্রকৃত অভিনেতা-অভিনেত্রী-নাট্যকার।
আমি বহু শিক্ষিত মানুষ বা বহু সতীর্থর মুখে বহু বার শুনেছি একটা অদ্ভুত কথা: ‘ইস্ কী বাজে, পুরো যাত্রা করে ফেলল’। প্রকৃত যাত্রাশিল্পী কিন্তু এক জন পূর্ণাঙ্গশিল্পী। নাচে, গানে, বাচিক এবং শারীরিক অভিনয়ে তিনি সম্পূর্ণ। তাই যাত্রা করে ফেলাটা সহজ কথা নয়। যাত্রাভিনয় মানে উচ্চগ্রামে স্বরক্ষেপণ বা মেলোড্রামা নয়। এই বোধটাই, এই বার্তাটাই যাত্রার পরিচালক, প্রযোজক বা অভিজ্ঞ শিল্পীরা পৌঁছে দিতে পারেনি সেই সব মানুষ বা অভিনেতা-অভিনেত্রীর হৃদয়ে। তাই হয়তো আজ এই অবনতি। কিন্তু লাস্ট সিন বা যবনিকা পতনের প্রতীক্ষায় এ কথাটা সবৈর্র্ব সত্যি হতে পারে না। সব শিল্প মাধ্যমেরই সময় ভাল-খারাপ আসে, আঙ্গিক বদল হয়। এক সময় বাংলা ছবি সম্পর্কে মানুষজন এমন রব তুলেছিল, তা কি সত্যি হল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যাত্রার মতো একটা লোকশিল্প, মা-মাটির শিল্প শেষ হওয়ার নয়। দায়িত্ব নেওয়ার মতো মানুষজন অল্প হলেও নগণ্য নয়। ব্যতিক্রমের পরাকাষ্ঠা হয়ে না থেকে তাঁরা যাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিন। এখনও কিছু উদ্যোগী প্রযোজক আছেন যাঁরা নতুন মুখ নিয়ে আসছেন। তাঁরা যদি সেই অভিনেত্রীদের পোশাক ছোট না-করে অভিনয়টাকে বড় করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন, একটু কর্পোরেট ভাবনাকে মিশ্রিত করেন, তা হলে যাত্রা আবার নতুন ভাবে নতুন দিন দেখবে। সবার উপরে রয়েছেন আমাদের যাত্রামোদী দর্শক আর আমাদের শিল্পপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যদি মমতার দৃষ্টি নিয়ে এই মাটির শিল্পের প্রতি আলোকপাত করেন, তা হলে বাংলার আসরে চার দিক খোলা মঞ্চে যাত্রা রমরমিয়ে চলবে।
সুকান্ত সরকারের ‘চিৎপুর চিত্র’র (১-১২) বিশ্লেষণটি পড়ে ভাল লাগল। তিনি যে ভাবে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সামনে ফেলে সমস্যাটির ক্ষত খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কেন এই অবক্ষয়? তা এক কথায় সাধুবাদ প্রাপ্য।
আমরা যারা সংস্কৃতিপ্রেমী বিভিন্ন ইভেন্টের সঙ্গে যুক্ত, তারা কেউই চাই না, সেই শিল্পটির গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটুক। বর্তমানে আমরা যে সময়টাতে বসবাস করি, সেই সময়টাতে বিশ্বায়নের হাত ধরে আমাদের চাহিদাটাও পাল্টে গেছে। আজকের দুনিয়ায় বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হল, টি ভি। তবুও টি ভি-র আকর্ষণ ফেলে মানুষ কিন্তু নাটক দেখতে হলে যাচ্ছে। কিন্তু যাত্রা নয় কেন? কারণ, যাত্রার সেই গাম্ভীর্য পরিবেশ কোথায়? তাই সরাসরি টি ভি-কে দায়ী না-করে দায়ী করা উচিত যাত্রাদলের মালিকদের। ভোগবাদী সমাজে অধিক মুনাফা অর্জনই হল পুঁজিবাদের লক্ষ্য। তাই, অধিক মুনাফা লাভের জন্য তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হল অন্যতম একটা কারণ।
একদা যাত্রায় অভিনয় করে শান্তিগোপাল, অরুণ দাশগুপ্ত, দ্বিপেন চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস ধাড়া, দ্বিজু ভাওয়াল, তরুণ কুমার, অভয় হালদার, বহরমপুরের দুই সন্তান স্বপন কুমার, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, খোকন বিশ্বাসেরা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ‘একদিন রাত্রে’ যাত্রাপালায় অভিনয় করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রয়াত মাখনলাল সমাদ্দার। এঁদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, ভালবাসায় যাত্রার মান ছিল ঊর্ধ্বমুখী এবং সেই সময় যাত্রাকে জনপ্রিয় করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায় কর্মরত যে মানুষটি প্রবোধবন্ধু অধিকারী।
যাত্রাশিল্পের রমরমা যখন আকাশচুম্বী তখনই এক শ্রেণির ফড়ে, পালা-প্রধানেরা হামলে পড়লেন বলিউড, টি ভি-র গ্ল্যামার বয় বা গ্ল্যামার কুইনদের পিছনে। যাত্রা হারাল তার নিজস্বতা। তাঁরা এলেন, অভিনয় করলেন, আর মোটা মোটা পেমেন্ট নিয়ে গেলেন। জোলো গল্প আর তাদের অভিনয়ের প্রতি ডেডিকেশনের অভাব বোধ যাত্রাশিল্পের গলায় পড়াল ফাঁস। আমুদেপ্রিয় যাত্রামোদী দর্শকেরা প্রতারিত হলেন। রাতের পর রাত লস খেয়ে সেই মালিকেরা রণে ভঙ্গ দিলেন। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিল যাত্রার দিক থেকে।
একজন নাট্যকর্মী হিসেবে এ টুকু বুঝি, মঞ্চাভিনয়, যাত্রাভিনয়, সেলুলয়েডের সামনে অভিনয় সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি শিল্পের একটা নিজস্ব সত্তা রয়েছে। যাত্রারও নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে, আছে ফ্লেভার, আছে টোম। মঞ্চের ওপর রাখা তিনটি রোস্ট্রামের উপর দাঁড়িয়ে, শহরকেন্দ্রিক ভাষায়, নিম্নমার্গের অভিনয় দ্বারা যাত্রাভিনয় হয় না। এই অভিনেতা অভিনেত্রীদের যাত্রাতে এনে যাত্রাদলের মালিকেরা প্রকৃত অর্থে যাত্রারই ক্ষতি করেছেন।
এই ফাঁস কেটে বের হতে হলে চেনা ছকের মাধ্যমেই হাঁটতে হবে। মঞ্চসফল পালাগুলিকে আবার নতুন করে সাজাতে হবে যাত্রাশিল্পীদের দিয়েই। আজ হয়তো হবে না। কিন্তু কে বলতে পারে, কাল আবার গ্রামগঞ্জের মঞ্চে সন্ধ্যা সাতটায় কনসার্ট বেজে উঠবে না ঝমঝমিয়ে। স্বয়ং ঠাকুরই তো বলেছেন ‘চৈতন্য হোক’।
গল্প বলা
বিদেশে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধরা নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে স্টোরি টেলার খোঁজেন। তাঁর কাজ সন্ধেবেলায় একাকিত্ব কাটাতে নিঃসঙ্গ ব্যক্তির বাড়ি হাজির হওয়া। জলযোগ সহযোগে পানীয় গলাধঃকরণ করতে করতে গল্প বলা। আমাদের দেশেও কোনও কোনও বাড়িতে গৃহস্বামীর নিঃসঙ্গতা কাটাতে এ ধরনের গল্পবাগীশ বন্ধুর আগমন ঘটে। চা-পান সহযোগে গল্পের আসর জমে ওঠে। আড্ডা শেষ হলে যে যার বাড়ি চলে যায়। এই বৃদ্ধরা কেউ নিঃসন্তান, কারও ছেলে বিদেশে থাকে, কেউ বা বিপত্নীক। এই সব আড্ডায় লঘু হাস্যরস থেকে শুরু করে নানান পারিবারিক সমস্যা ওই সব বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা হয়। এতে তাঁদের একাকিত্ব অনেকটা দূর হয়। অর্থের বিনিময়ে নয়, আন্তরিকতায় বন্ধুত্ব গভীর হয়। প্রসঙ্গত, প্রাচীন কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলেও ধনী ব্যক্তিদের বৈঠকখানায় বৈঠকি আড্ডা বসত। এই সব আড্ডায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হতেন। আড্ডার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাসংস্কৃতির উন্মেষ ঘটানো।
আবার বুড়োদের বৈকালিক আড্ডা জমে ওঠে কোনও পার্কে, লেকের ধারে, কলোনির বাঁধানো রাস্তার ওপরে বা অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে। আড্ডায় আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানি সকলেই জুটে যায়। কোনও নিজস্ব ভাবধারা থাকে না এই আড্ডায়। শ্লীল, অশ্লীল, রাজনীতি, গৃহসমস্যা, সব কিছু মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি আড্ডা। এই আড্ডায় জানা যায়, কোন বাড়ির গৃহকর্তা বাজার থেকে ডিন কিনে এনে তার ওপর বারের নাম লিখে রাখেন। সেই বার দেখে দেখে ডিম খরচ হবে। কেউ আবার দূরে বেড়াতে যাওয়ার আগে বুড়োবুড়ি, শ্বশুরশাশুড়ির সাত দিনে দিনরাতের খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়। বুড়োবুড়িদের সেই সব খাবার গরম করে খেতে হয়।
এখানেও স্টোরি টেলার থাকে। শোনায় এ যুগের অবক্ষয়ের গল্প। এমন একটা গল্প এখানে লিপিবদ্ধ করলাম। গল্পের নাম ‘ঠাকুরদার ভাঙা পাথর বাটি’। কোনও একটি পরিবারে পুত্রবধূ তার বৃদ্ধ শ্বশুরকে কুকুর, বেড়ালের মতো একটা ভাঙা পাথরবাটিতে খেতে দিত। এক দিন বৃদ্ধটি মারা গেলেন। বাটিটার প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে সেটাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এক দিন পুত্রবধূটি লক্ষ করলেন, তাঁর ছোট ছেলে ওই পাথর বাটিটা সেখান থেকে নিয়ে ঘষেমেজে পরিষ্কার করছে। বধূটি রে রে করে ছেলেটির দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, কী করছিস কী? ওই বাটিটা আর লাগবে না। ছোট ছেলেটি জবাবে বলল, সে কী মা, তোমরা যখন দাদুর মতো হবে তখন এই পাথরবাটিতে আমার বউ তোমাদের খেতে দেবে তো! এই গল্প শুনে সকলে হেসে ওঠে। হয়তো অলক্ষ্যে কারও চোখের কোল ঘেঁষে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
নোব্ল মিশন
তৃতীয় কলকাতা আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনের যে ছবি ও সংবাদ প্রকাশিত (কলকাতা, ২০-১২) হয়েছে, তা আমাদের অত্যন্ত আনন্দ প্রদান করেছে। কিন্তু সে দিন মঞ্চে ‘ইনস্টিটিউট অব সেরিব্রাল পলিসি’র ছাত্রী শুভাঙ্গী উপস্থিত থাকলেও এই ছবিটিতে সে অনুপস্থিত। যে তিনজন শিশুর ছবি ও তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাদের বিদ্যালয়টির নাম হল নোব্ল মিশন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.