অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁহার আম আদমি পার্টি একটি বড় পরীক্ষায় বসিতেছেন। পরীক্ষাটি কেবল সরকার চালাইবার নহে। বস্তুত, সরকার চালাইবার পরীক্ষা ভারতীয় গণতন্ত্রের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে নিতান্ত গৌণ। একটি নূতন এবং ভিন্ন ধরনের দল দিল্লিতে সরকার চালাইতে সফল হইল কি না, তাহা সেই বৃহত্তর ইতিহাসের নিতান্ত ক্ষুদ্র অংশ। হয়তো বা পাদটীকা। কিন্তু ইহার এক ভিন্ন এবং গভীরতর তাৎপর্য আছে। নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ হইতে প্রধানত সেই সমাজের ক্ষোভ, দাবি ও স্বার্থকে কেন্দ্র করিয়া রাজনীতির পরিসরে আবির্ভূত একটি দল প্রশাসনের নূতন ধারা তৈয়ারি করিতে পারে কি না, সেই ধারাটি কার্যকর বিকল্প রচনা করিতে সক্ষম হয় কি না, তাহার মধ্য দিয়া রাজনৈতিক দলের ধারণায় কোনও নূতন মাত্রা যুক্ত হয় কি না, এই সব প্রশ্নই আপাতত আম আদমি পার্টির দিকে চাহিয়া আছে ও থাকিবে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা চাহিলেও এবং পারিলেও তাঁহাদের কতটা কাজ করিতে দেওয়া হইবে, সেই প্রশ্ন তুচ্ছ করিবার উপায় নাই। প্রথমে ‘শর্তহীন সমর্থন’-এর প্রস্তাব দিবার পরে কংগ্রেস ইতিমধ্যেই শর্তের কথা জানাইয়া দিয়াছে। তদুপরি, আদৌ কেন সমর্থন করা হইল, দলের মধ্য হইতে সেই প্রশ্নও উঠিয়া আসিয়াছে। কংগ্রেস আপ সরকারের সাফল্য চাহিতেছে এমনটা বিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই। বিজেপি’র অবস্থান প্রথম হইতেই প্রকট। সুতরাং কেজরিওয়াল কাঁটার মুকুট পরিতেছেন, তাহা তিনি নিশ্চয়ই জানেন।
কিন্তু তাঁহার এবং তাঁহার দলের সামনে সুযোগটিও কম নয়। চেষ্টা করিবার সুযোগ। বস্তুত, সমস্যা এবং বিপদগুলি প্রথম হইতে অত্যন্ত স্পষ্ট বলিয়াই সুযোগও সমধিক। কিন্তু তাহাকে কাজে লাগাইতে চাহিলে তাঁহাদের সম্পূর্ণ সততার সহিত নীতি রচনা এবং রূপায়ণে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। এই সততা কেবল প্রচলিত অর্থে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ব্যাপার নয়। বাস্তবকে স্বীকার করিয়া এবং পূর্ণ মর্যাদা দিয়া প্রশাসনের পথ স্থির করাও সততার অঙ্গ। প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের অনাচারের প্রতিবাদে আন্দোলন করিয়া ক্ষমতায় আসিবার পরে এই দলকে শুরু হইতেই বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করিতে হইবে। নচেৎ অনাচার দূর করিতে গিয়া শৃঙ্খলা এবং যুক্তি বিসর্জন দেওয়ার আশঙ্কা থাকিয়া যায়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ‘বৈপ্লবিকতা’ সুশাসনের পথ রোধ করিয়া দাঁড়ায়। আম আদমি পার্টির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন কারণে সেই আশঙ্কা প্রবল। দৃষ্টান্ত: বিদ্যুতের মাশুল কমাইবার প্রতিশ্রুতি অর্থনীতির যুক্তির বিরোধী। জনসম্মোহনের পায়ে অর্থনীতিকে বিসর্জন দিলে কী সমস্যা হয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত তাহা ঠেকিয়া শিখিতেছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী দেখিয়া শিখিবেন কি?
এখানেই পরীক্ষা। নিছক একটি দলের পরীক্ষা নয়, সামগ্রিক ভাবে নাগরিক সমাজের পরীক্ষা। গত কয়েক বছরে ভারতে নাগরিক সমাজ নূতন করিয়া জাগ্রত হইয়াছে, নূতন পরিসর দখল করিয়াছে, নূতন রাজনীতির সূচনা করিয়াছে। আপ-এর রাজনৈতিক সাফল্য বড় অর্থে সেই ব্যাপকতর প্রক্রিয়ারই পরিণাম। পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ধারণা ছিল, নাগরিক সমাজ বিভিন্ন প্রশ্নে সংগঠিত হইয়া প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলির উপরে গণতান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করিবে, তাহাদের আত্মশুদ্ধিতে বাধ্য করিবে। প্রতিবাদী নাগরিকরা সরাসরি রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিবে এবং সরকার গড়িবে, ইহা অপ্রত্যাশিত ছিল। সেই ঘটনা যে ঘটিয়াছে, তাহা গণতন্ত্রের শক্তিকেই দেখাইয়া দেয়। এই নূতন দলবা সংগঠন প্রশাসনিক সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারিলে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আরও জোরদার হইবে। সেখানেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁহার সহযোগীদের বিশেষ দায়িত্ব। |