তখনও সূর্য ওঠেনি।
বাঁশদহ বিলের জলে কয়েকটি কাঠের নৌকা এক করে বাঁধা হয়েছে ভাসমান মঞ্চে একে একে ভিড় করছে বাউল ও ফকিরের দল। সুর বাঁধা হচ্ছে একতারা, দোতারা ও খমকে। ঠিক সূর্য ওঠার মুর্হূতে বেজে উঠল সানাই। শুরু হল উৎসব। বেলা বাড়তেই বিলের পাড়ে উপচে পড়ল ভিড়। মন কেমন করা সুরে মিলে গেল মঞ্চের শিল্পী ও পাড়ের দর্শক। বুধবার শুরু হওয়া পূর্বস্থলী ১ ব্লকের শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতের কোবলা গ্রামে জনপ্রিয় খালবিল ও চুনোমাছ উৎসবের এটাই ছিল সারাংশ। এ বছর ১৩ বছরে পা দেওয়া এই উৎসবের উদ্বোধন করেন রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। উপস্থিত ছিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। |
২০০০ সালে এলাকার মানুষকে নিয়ে এই উৎসবের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন রাজ্যের বর্তমান মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। উৎসবের মূল লক্ষ্য ছিল, এলাকার জলাভূমিগুলির দূষণ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন করা। ২০০৬ সাল থেকে এই উৎসব থেকে চুনো মাছ বাঁচানোর ডাক দেওয়া হয়। এ দিনের অনুষ্ঠানের অতিথি বরণ হয় বিলের জলে ফোটা শাপলা ফুল দিয়ে। অতিথি ও নিমন্ত্রিতদের বিশ্রামের জন্য বিলের পাড়েই দু’টি তাঁবু তৈরি করা হয়েছিল। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে ছিল খেজুররস। এলাকার স্বয়ম্বর গোষ্ঠীর সদস্যরা পাড়েই তৈরি করছিলেন চালের পিঠে, পাটিসাপটা ও নলেন গুড়ের পায়েস। মৎস্য দফতর থেকে খোলা হয়েছিল সচেতনতা শিবির। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ ধরার পদ্ধতি শেখানো হয়। চুনো মাছ বাঁচাতে ও তৈরি করতে কী কী করা উচিত, সেই বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়। মৎস্যজীবীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম। খুদেদের জন্য ছিল ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতা। বিলের জলে ছিল নৌকাবিহারের ব্যবস্থা। আলাদা একটি বোটে জেলাশাসক সস্ত্রীক এলাকা ঘুরে দেখেন। জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “পাটিসাপটা, খেঁজুররস খেয়ে সারা দিন খুব আনন্দ করেছি। এই জায়গায় নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুললে স্থানীয় অর্থনীতি উন্নত হবে। জেলা প্রশাসন এই ব্যাপারে উৎসব কমিটির পাশে রয়েছে।”
এ বারের উৎসব শুরুর আগে স্থানীয় শ্রীরামপুর পঞ্চায়েত থেকে ১০০ দিনের প্রকল্পে বাঁশদহ বিলের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়। দু’দিনের উৎসব উপলক্ষে বিল লাগোয়া প্রায় সব রাস্তাতেই লাগানো হয় রঙিন পতাকা। ছিল জলাশয় বাঁচানোর বিষয় সর্ম্পকিত একাধিক পোস্টার। বিলের অন্য প্রান্তে ছিল আরও একটি মঞ্চ। সেখানে ছিল অতিথিদের জন্য দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। এ দিন দুপুরের মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, কাঁকড়ার ঝাল, বিলের জল থেকে ধরা রুই মাছের কালিয়া, তেল কই, চাটনি ও পায়েস। অনুষ্ঠানে মৎস্যমন্ত্রী বলেন, “গত এক বছরে মাছের আকাল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে রাজ্য। তবু এখনও পুরো সফল হওয়া যায়নি। আমাদের লক্ষ্য, মাছ উৎপাদনে রাজ্যকে দেশের মধ্যে প্রথম করা। তাঁর সংযোজন, “আমাদের রাজ্যে বহু চুনো মাছ অবলুপ্তির পথে। চুনো মাছের জোগানের দিকে আমরা নজর দিয়েছি।”
উৎসব কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা রাজ্যের ক্ষুদ্র, কুটির ও বস্ত্র বয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “রাজ্যের পর্যটন ও মৎস্য দফতর থেকে বাঁশদহ বিলকে ঘিরে নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ জন্য পর্যটন দফতর ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা অনুমোদন করেছে। এই টাকায় বিলের পাশে একটি পর্যটক আবাস-সহ এলাকার ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে ঢেলে সাজানো হবে।” স্থানীয় বিদ্যানগরে চুনোমাছ চাষের জন্য আলাদা একটি পুকুর তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। উৎসব কমিটির সম্পাদক দিলীপ মল্লিক জানান, উৎসব উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দিনভর নানা অনুষ্ঠানের পরে সন্ধ্যায় বিলের জলে প্রদীপ ভাসিয়ে উৎসব শেষ হবে।
সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষের মুখে। একতারা বাজিয়ে তখনও গান গেয়ে চলেছেন এক উদাস বাউল। চুনোমাছ বাঁচিয়ে তোলার জন্য আরও উদ্যোগী হতে বলছিলেন তিনি। গান ও নানা অনুষ্ঠানে আজও এই কথাই বলবেন উৎসবের কর্তা থেকে অতিথিরা।
বাঙালি পাতে চুনোমাছ ফিরিয়ে আনার জন্য সচেতনতা তৈরি যে এ বারের খালবিল উৎসবের প্রধান লক্ষ্য। |