নিজস্ব সংবাদদাতা • শিলিগুড়ি |
প্রতি বছর চায়ের উৎপাদন বাড়লেও বাজারের পরিধি বাড়ছে না। ফলে, বিক্রি নিয়ে উত্তরবঙ্গের চা শিল্পোদ্যোগীদের উদ্বেগ বরাবরের। সম্প্রতি সিআইআই-এর উত্তরবঙ্গ শাখা আয়োজিত দু’দিনের চা ফোরামের পরে খানিকটা হলেও আশার আলো দেখছেন উত্তরের চা শিল্পোদ্যোগীরা।
শিলিগুড়িতে আয়োজিত দু’দিনের এই আলোচনাসভায় উত্তরবঙ্গের চায়ের নতুন বাজারের সন্ধান মিলেছে। আলোচনায় আসা দেশের নানা প্রান্তের প্রতিনিধিদের অনেকের বক্তব্যে সে কথাই উঠে এসেছে। বিশেষত, উত্তরবঙ্গের চা শিল্প মহলকে উৎসাহ জোগাচ্ছে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য। কারণ, গুজরাতে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। মাথা পিছু চা পানের হারে দেশের হারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে গুজরাত।
শিলিগুড়ির একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত ওই আলোচনায়সভায় উঠে এসেছে, গুজরাতে চা তৈরি না হলেও, চায়ের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। মূলত, সিটিসি চায়ের চাহিদাই বেশি। বর্তমানে অসম চা-ই গুজরাটের বাজারের সিংহভাগ দখল করে থাকলেও, ‘ঘন লিকারের’ কারণে উত্তরবঙ্গের চায়ের কদর-ই বেশি সে রাজ্য, এমনই জানিয়েছেন গুজরাত তথা উত্তর ভারতের চা প্রস্তুত এবং বিপণনকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি সিআইআইয়ের উদ্যোগে শিলিগুড়িতে আয়োজিত ‘টি ফোরামে’ গুজরাত-সহ উত্তর ভারতের প্রথম সারির অন্তত ১০টি চা বিপণনকারী সংস্থাগুলির প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। ফোরামে আসা গুজরাতের ব্যবসায়ীরা আগামী বছর থেকে সরাসরি উত্তরবঙ্গে এসে চা কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইতিমধ্যে সংস্থাগুলির সঙ্গে উত্তরবঙ্গের শিল্পোদ্যোগীদের এ বিষয়ে একপ্রস্ত আলোচনাও হয়ে গিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
গুজরাতে উত্তরবঙ্গের চায়ের কদর বেশি হওয়ার কারণ কী?
চা পর্ষদের উত্তরবঙ্গের উপ-অধিকর্তা কল্যাণকুমার ভট্টাচার্য বললেন, “গুজরাতে চায়ে দুধ মিশিয়ে খাওয়ার প্রবণতাই বেশি। ওখানে মোষের দুধের জোগানই বেশি। মোষের ঘন দুধে অসম চায়ের হালকা লিকারের থেকে উত্তরবঙ্গের সিটিসি চায়ের ঘন লিকার মিশে একটা লালচে ভাব নেয়। সে রকম চা-ই গুজরাটের বাসিন্দারা বেশি পছন্দ করেন। ফোরামে আসা গুজরাতের চা বিপণন সংস্থাগুলির প্রতিনিধিরাও তাই-ই জানিয়েছেন।” কল্যাণবাবুর কথায়, “এতদিন শুধুমাত্র নিলাম এবং কিছু সরাসরি বিক্রির সুযোগ ছিল। গুজরাতের সংস্থাগুলি সরাসরি উত্তরবঙ্গে এলে বিপণন নিয়ে কোনও চিন্তা থাকবে না বলেই আমার মনে হয়।”
ফোরামের আলোচনায় জানা গিয়েছে, গত তিন বছর ধরেই উত্তরবঙ্গের চা উৎপাদন বেড়ে চলছে। ২০১১ সালে ২৭৩ মিলিয়ন কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে ২৭৮ মিলিয়ন কেজি এবং চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ২৯০ মিলিয়ম কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এই চা উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ হল ক্ষুদ্র চা বাগানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। ফোরামের আলোচনায় পর্ষদ সূত্রেই জানানো হয়েছে, উত্তরবঙ্গের মোট চা উৎপাদনের প্রায় ৪৮ শতাংশ আসে ছোট বা মাঝারি চা বাগান থেকে। প্রতি বছর যে হারে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে সে ভাবে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ না আসায় কিছুটা উদ্বেগেই ছিলেন চা শিল্পোদ্যোগীরা। গুজরাত সে উদ্বেগে মুশকিল আসানের কাজ করতে চলেছে বলে মনে করছে শিল্প মহল। গুজরাতে চায়ের চাহিদা বছরে অন্তত ৭৫ মিলিয়ন কেজি। জন পিছু চা পানের হারেও গুজরাত দেশের অন্য রাজ্য থেকে এগিয়ে। সে কারণে গুজরাত নিয়ে আশাবাদী শিল্প মহল।
সিআইআইয়ের উত্তরবঙ্গ শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রবীর শীল বলেন, “প্রতি বছর চায়ের দাম না পাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। সঠিক বিপণনের অভাবেই এটা হয়। গুজরাতের সংস্থাগুলি এলে সে সমস্যা মিটবে।” ‘টি ফোরামে’ উপস্থিত ছিলেন ক্ষুদ্র চা চাষিদের সর্বভারতীয় সংগঠন সিস্টা-র সম্পাদক বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, “এর ফলে ছোট চা চাষিরা সবচেয়ে উপকৃত হবেন। চাহিদার অভাবে দাম না পাওয়ার সমস্যা কিছুটা কমবে।”
গত ১৩-১৪ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে আয়োজিত ‘টি-ফোরামেই’ সেতু বন্ধন হয়েছে গুজরাত এবং উত্তরবঙ্গের। যদিও তার অন্যতম শর্ত চায়ের গুণগত মান। উত্তর ভারতের একটি প্রথম সারির চা বিপণন সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রমেশচন্দ্র অগ্রবাল বলেন, “অসম চায়ের থেকেও উত্তরবঙ্গের চায়ের ভবিষ্যত গুজরাতে উজ্জ্বল। কিন্তু তার জন্য প্রথম শর্ত হল উৎপাদিত চায়ের গুণগত মান।”
মান ঠিক রেখে বিপণনের সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যায়, সেটাই উত্তরবঙ্গের চা শিল্প মহলের কাছে আপাতত চ্যালেঞ্জ। |