|
|
|
|
|
মোদীর নেতৃত্বে আসন
বাড়ানোই সঙ্ঘের অগ্নিপরীক্ষা |
|
সঙ্ঘ নরেন্দ্র মোদী নামক এমন এক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরকে বাছল যিনি দলের কর্মী-সমর্থকদের
কাছে একাধারে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’, অন্য দিকে‘বিকাশ পুরুষ’। লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
বুধবারের আড্ডায় আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই। গত সপ্তাহেই দিল্লির বাঙালিদের প্রতিষ্ঠান চিত্তরঞ্জন ভবনে এক আলোচনাসভায় উপস্থিত প্রায় সকলেরই প্রশ্ন ছিল, ‘নরেন্দ্র মোদী কি পারবেন?’
২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েই ছিল আড্ডা। জনৈক প্রবীণের প্রশ্ন, ‘দেশ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ বিষয় মোদী-তুফান। সত্যি কি তুফান? তা-ই যদি হয় তা হলে দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উদ্ভবের রহস্য কী?
শাহি দরবারের আড্ডাতেও আজ নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু প্রথমেই বলব, ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা যত বড়ই হোক না কেন, ব্যক্তি সর্বদাই এক প্রেক্ষাপটের কার্যকারণের সম্পর্কে বাঁধা থাকেন। ক্ষয়িষ্ণু জারতন্ত্র, রাশিয়ার মানুষের অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রকাশের প্রকৃতি, বলশেভিক পার্টির জন্মের সঙ্গে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের উত্থান যুক্ত হয়ে আছে। কার্ল মার্কস লন্ডনের লাইব্রেরিতে বসে চাইলেও সে বিপ্লব ইংল্যান্ডে হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের প্রধান কারিগর, কিন্তু সিপিএমের প্রতি মানুষের অসন্তোষের প্রধান রাজনৈতিক কারবারি ছিলেন তিনি। সিপিএম বিরোধিতার প্রধান প্রতীক।
লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ নিজের ঘরে বসে অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমাকে বলেছিলেন, “মমতা ইজ দ্য সাকসেসফুল পলিটিক্যাল অন্তেপ্রেনিওর অফ দ্য ডিসকনটেন্ট অফ বেঙ্গল।” মমতা সম্পর্কে একটি বাক্যে এ হেন অসাধারণ বিশ্লেষণ আমি শুনিনি। |
|
এই সাতকাহন করছি কেন?
করছি, কারণ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখল করতে পারবে কি না সেটা বোঝার জন্য দেশের সর্বভারতীয় পরিস্থিতিটা আজ ঠিক কোন জায়গায় এসে পৌঁছেছে সেটা আগে বুঝতে হবে।
গোটা দেশে এখন কংগ্রেস তথা মনমোহন সিংহ তথা ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষের হাওয়া। মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি, নীতি পঙ্গুতা, প্রশাসনিক অযোগ্যতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত মানুষ হতাশ, বিরক্ত, ক্লান্ত। আর তাই পরিবর্তনের পক্ষে হাওয়া আছে যা কংগ্রেসের জন্য প্রতিকূল।
ঐতিহাসিক ই এইচ কার তাঁর ‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি’ বইতে লিখেছিলেন, কড়ায় দুধ জ্বাল দিলে তা উথলে ওঠে কেন? আমি বললাম, দুধের মধ্যে উথলে ওঠার একটা ঝোঁক আছে। এতে কি কার্যকারণ সম্পর্ক জানা গেল? না, প্রকৃতি বিজ্ঞানী তার ব্যাখ্যা দেবেন। কেউ যদি বলেন হিটলারের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল, তবে সেটি কিন্তু সঠিক ব্যাখ্যা নয়। কার বলেছেন, ঐতিহাসিকের কাজ একই ঘটনার একাধিক কারণ খোঁজা। আবার অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেছেন, কোনও কারণের ফলের সঙ্গে সঙ্গে অন্য নানা কারণের ফলও মিলেমিশে থাকে। নরেন্দ্র মোদীর উত্থানও তাই শুধু মোদীর জন্য নয়, সাম্প্রতিক পটভূমিটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ইতিহাসে ’৬৭ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস গোটা দেশের রাজ্যে রাজ্যে প্রথম ধাক্কা খায়। চিনের যুদ্ধ ৬২ সালে, ৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যু। উত্তর-নেহরু কংগ্রেসের অবক্ষয় শুরু ’৬৭তে। তার পর ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস আবার মাথা চাড়া দেয়, ইন্দিরা ’৭১ সালে ‘দুর্গা দুর্গতিনাশিনী’ হয়ে উঠলেও, ’৭৫ সালেই জরুরি অবস্থা। যার পরিণাম ’৭৭-এর কংগ্রেস-বিরোধী ঝড়। আবার ’৮৭-’৮৮ সালে রাজীব গাঁধীর পতনের আখ্যান। ’৮৯ সালেও আমরা দেখলাম বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের উত্থান। লোকসভা নির্বাচনের আগে ইলাহাবাদের উপনির্বাচনে সুনীল শাস্ত্রীকে যখন বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ পরাস্ত করলেন তখনও প্রশ্ন ছিল, ‘বিশ্বনাথপ্রতাপ পারবেন কি?’
বিজেপি-র কথায় আসি। ১৯২৫ সালে আরএসএস-এর জন্ম। ১৯৫১ সালে জনসঙ্ঘের জন্ম। আর ১৯৮০ সালে জনসঙ্ঘ হল বিজেপি। ’৮০-র শেষ পর্বে এবং ’৯০-এর গোড়ায় এক উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থান হয়। কিন্তু, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ তারা হতে পারেনি। ’৭৭ সালেও জয়প্রকাশ নারায়ণের মধ্যপন্থী শক্তির হাত ধরে জনসঙ্ঘ প্রসারিত হয়েছে।
কংগ্রেস থেকে এলেও সে দিন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রধান প্রতিপক্ষ কেন হতে পারেননি সে বিশ্লেষণ খুব ভাল করেছেন ক্রিস্টোফো জাফরেলট (christophe jafferlot)। তিনি প্যারিসের institute d’ etudes politiques-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক। বিজেপি নিয়েই তাঁর পিএইচডি। ক্রিস্টোফো-র বক্তব্য, এক) ভারতে হিন্দুধর্মের চরিত্র মোনোলিথিক র্যাডিক্যালিজম নয়। ওঁর ভাষায়, ‘হিন্দুইজম ইজ ডিস্টিংগুইশড বাই আ সোসিওকালচারাল ডিফারেন্সিয়েশন অ্যান্ড আ ক্যাপাসিটি ফর ইন্টিগ্রেশন হুইচ হার্ডলি সিম কম্প্যাটিবল উইথ দ্য এক্সপ্রেশন অফ আ মিউচুয়াল কালেক্টিভ কনশাসনেস।
দুই) হিন্দুধর্মের ভিতর উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের সংঘাতও জনসঙ্ঘের হিন্দুত্ব প্রসারের পথে বাধা ছিল। আরএসএস এবং বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যে ব্রাক্ষ্মণদের প্রাধান্য ছিল।
তিন) ’৮৬ সালের পর থেকে কংগ্রেস ভোটের জন্য এমন কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নেয় যাতে বিশেষত হিন্দি বলয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি পায়। ’৮৬-তে ফৈজাবাদ আদালত নির্দেশ দেয় বাবরি মসজিদ/রাম জন্মভূমি মন্দিরের ভিতরে গিয়ে ভক্তদের দর্শন ও পুজা দেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক। রাজীব গাঁধীর দিল্লি সরকার এবং উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস সরকার, কেউই আদালতের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পায়নি, তাতে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ ক্ষুব্ধ হয়। আবার মুসলিম উইমেন বিল (প্রোটেকশন অফ রাইট টু ডিভোর্স) যা শাহবানু মামলা বলে পরিচিত তাতে রাজীব গাঁধী গোঁড়া মুসলমানদের খুশি করলেও গোটা দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া হয়। আর এই সময়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-এর সাহায্য নিয়ে লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বে বিজেপি ‘হিন্দুভোট’কে সুসংহত করার চেষ্টা করে।
’৮৪-তে লোকসভায় বিজেপি মাত্র দু’টি আসন (৭.৬৮ শতাংশ ভোট) পেয়েছিল। ’৮৯-তে এটা হয় ৮৬ (ভোট ১১.৫ শতাংশ)। ’৯১ সালে ১২০টি আসন আর ’৯৬-তে ১৬১টি আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় বিজেপি। |
১৯৯২ সালের সেই দৃশ্য। —ফাইল চিত্র। |
বাবরি মসজিদ ভাঙায় কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিজেপি-রই। গোটা দেশজুড়ে হিন্দু ভোট সুসংহত করার চেষ্টাটাই হচ্ছিল যে আন্দোলনকে সামনে রেখে সে আন্দোলনই হয়ে গেল মৃত। বিজেপি-র ভিতরেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক বাড়ল। ’৯৩ সালের পর থেকে দেখা গেল বিজেপি নতুন অভিমুখে যাত্রা শুরু করতে চাইছে। দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অযোগ্যতার বিরুদ্ধে কংগ্রেস বিরোধিতাকে তীব্র করে ’৯৫ সালে পশ্চিম ভারতেও বিজেপি ফায়দা পায়। বিজেপি বুঝতে পারে, জোট ছাড়া গতি নেই।
কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনী কৌশল ঠিক করতে গিয়ে বিজেপি তা হলে নরেন্দ্র মোদীকে বাছল কেন?
কারণ একটাই। বিজেপি-র উপলব্ধি, কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া আছে সত্য, কিন্তু বিজেপি যতই প্রচার করুক দক্ষিণ ভারত ও পূর্ব তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিজেপি-র পক্ষে খুব কঠিন প্রয়াস। (যদিও কর্নাটকে ইয়েদুরাপ্পাকে ফিরিয়ে এনে নরেন্দ্র মোদী শক্তি বাড়াতে চান সে রাজ্যে) ইতিমধ্যে হিন্দি বলয় রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় সর্বত্রই আসনসংখ্যা কার্যত ‘স্যাচুরেটেড’। এই অবস্থায় উত্তরপ্রদেশ (৮০) ও বিহারের (৪০) মোট ১২০টি আসনে দলের পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন যার জন্য ‘হিন্দুত্ব’ বিনে গীত নাই। সঙ্ঘ তাই নরেন্দ্র মোদী নামক এমন এক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরকে বাছল যিনি দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে একাধারে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’, অন্য দিকে ‘বিকাশ পুরুষ’। দেশের আর্থিক বৃদ্ধি শতকরা পাঁচ ভাগ হলেও গুজরাতে শতকরা দশ ভাগ। বাজপেয়ী যখন উদার মুখ ছিলেন তখন আডবাণী ছিলেন কট্টর হিন্দু নেতা। এখন তো মোদীই টু ইন ওয়ান। তবে নরেন্দ্র মোদী নিজে এখনও পর্যন্ত মুখে হিন্দুত্বের কথা বলছেন না। তিনি শুধু বিকাশের কথাই বলছেন। আর হিন্দুত্বের কথা বলছেন রাজনাথ সিংহ, কল্যাণ সিংহ থেকে অমিত শাহ। এ-ও এক ধরনের দু’মুখো রণকৌশল।
বিজেপি দেখেছে, হিন্দুত্ব পরিত্যাগ করে এনডিএ করতে গিয়ে দলের শতকরা ভোট কমেছে। ২০০৯ সালে বিজেপি-র ভোট হয়েছে শতকরা ১৮.৮০ ভাগ। দুই সমাজতাত্ত্বিক মিকলেথওয়েট এবং উলড্রিজ ২০০৯ সালে একটি বই লিখেছেন। জনপ্রিয় এই বইটির নাম ‘গড ইস ব্যাক’। গোটা পৃথিবী জুড়ে নাকি আবার ধর্মীয় মনোভাব মাথাচাড়া দিচ্ছে। হতে পারে আর্থিক মন্দা, হতে পারে আরও অনেক কারণ। কিন্তু কুসংস্কারও বাড়ছে। চার্চ থেকে দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে দর্শনার্থীর সংখ্যা প্রবল ভাবে বাড়ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রেগ জেফ্রি জন হ্যারিস এবং স্টুয়ার্ট করব্রিজ সম্প্রতি ভারতের বর্তমান রাজনীতির উপর গবেষণা করে লিখেছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে ‘ব্রেক’ কিছুটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু আবার উগ্র হিন্দুত্ব আর মেরুকরণের রাজনীতি বিজেপি-র বাধ্যবাধকতা হয়ে উঠেছে, ঠিক যেমন ২০০৪ পর্যন্ত বিজেপি করেছিল। মোদীর নেতৃত্বে তাই দলীয় আসনসংখ্যা বৃদ্ধি বিজেপি-র প্রাথমিক লক্ষ্য, এনডিএ-র শক্তিবৃদ্ধির কথা ভাববে তারা ভোটের পর। এটা একটা অগ্নিপরীক্ষা, সরকার গঠনের চেয়ে আপাতত মোদীর নেতৃত্বে দলের আসন সংখ্যার শ্রীবৃদ্ধি সঙ্ঘের আশু লক্ষ্য।
|
বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রতিযোগিতা |
সাল |
শতকরা ভোট |
আসন |
বিজেপি |
কংগ্রেস |
বিজেপি |
কংগ্রেস |
১৯৯১ |
২০.১১ |
৩৬.২৬ |
১২০ |
২৩২ |
৯৬ |
২০.২৯ |
২৮.৮০ |
১৬১ |
১৪০ |
৯৮ |
২৫.৫৯ |
২৫.৮২ |
১৮২ |
১৪১ |
৯৯ |
২৩.৭৫ |
২৮.৩০ |
১৮২ |
১১৪ |
২০০৪ |
২২.১৬ |
২৬.৫৩ |
১৩৮ |
১৪৫ |
২০০৯ |
১৮.৮০ |
২৮.৫৫ |
১১৬ |
২০৬ |
|
গ্রন্থঋণ
• The Hindu Nationalist Movement In India— Christophe Jaffrelot
• Bjp And The Evolution Of Hindu Nationalism— Partha S Ghosh
• India Today- Economics, Politics,
Society Stuart Corbridge, John Harriss, Craig Jeffrey
• What Is History- E H Carr |
পুরনো সমাচার: ফ্রন্ট গঠন নয়, এখন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে
যোগাযোগ দৃঢ় করতে চান মমতা |
|
|
|
|
|