|
|
|
|
|
ফ্রন্ট গঠন নয়, এখন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে
যোগাযোগ দৃঢ় করতে চান মমতা |
|
লোকসভায় দলীয় আসন সংখ্যা বাড়াতে পারলে জাতীয় রাজনীতির অস্থিরতায় তৃণমূলই
হবে
অন্যতম নির্ধারক শক্তি। সেটাই
এখন মমতার কাছে পাখির চোখ। লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
‘ইট ইজ এ টেল অফ টু মমতাস্’— মন্তব্যটি সংসদের হলে বসে করলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। এমআইটি গ্র্যাজুয়েট বুদ্ধিদীপ্ত ও রসিক জয়রামের বক্তব্য: তৃণমূলনেত্রীকে আমিও তো দেখছি অনেক বছর ধরে, পশ্চিমবাংলার জেলায় জেলায় তাঁর দাপট অব্যহত রাখেন এক মমতা, সেখানে তাঁর একটা স্টাইল, আর দিল্লিতে যখনই তিনি অবতরণ করেন তখন তিনি আর এক মমতা। জাতীয় রাজনীতির গন্ধ আগাম পান এই মা-মাটি-মানুষের নেত্রী।
আমি বললাম, কিন্তু এই দুই মমতা দু’টি বিচ্ছিন্ন কম্পার্টমেন্ট-ও কিন্তু নয়। একটি কক্ষ থেকে অন্য কক্ষের মধ্যে কিন্তু সেতু আছে। তাই কলকাতা-দিল্লি মমতার অবাধ আসা-যাওয়া।
এ বার এলেন আট মাস পর। অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের মতো ঘন ঘন দিল্লি আসেনও না তিনি। এ বার চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগে কলকাতায় যখন মমতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখনই তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “আপনারা তো আমাকে দিল্লি আসতে বলেন না। কিন্তু এ বার ভোটের ফল বেরনোর পর ভাবছি এক বার দিল্লি যাব।”
|
|
রাজনৈতিক দৌত্য। ফের সংসদের আঙিনায় মুখ্যমন্ত্রী
মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে মুকুল রায়। ছবি: পিটিআই। |
ভোটের ফলে কংগ্রেস যে চারটি রাজ্যেই পর্যুদস্ত হবে এ ব্যাপারে মমতা ছিলেন নিশ্চিত। এটাও তো ঘটনা যে এখন সংসদীয় অধিবেশনই বলুন আর কেন্দ্রীয় সরকরের কার্যকলাপ— সবই কার্যত শিকেয় উঠেছে। সংসদের পরিভাষায় বলা যায়, কেপ্ট ইন অ্যাবেয়েন্স। এই অবস্থায় কেউ কেউ লিখছেন, ফেডেরাল ফ্রন্টে কোনও আঞ্চলিক দলই মমতার প্রস্তাবে সাড়া দিল না।
আসলে এই মুহূর্তে এই ফ্রন্ট গঠনও অবান্তর অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। মাছ নয়, মমতা আপাতত দেখছেন মাছের চোখ। সেটি হল, পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে ক’টি আসন ছিনিয়ে আনা যায়, সেটিই তাঁর লক্ষ্য। তিনি জানেন এখন ১৯টি আসন তাঁর দলের।
যদি এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০টি করা যায় তা হলেই জাতীয় রাজনীতির অস্থিরতায় তিনি হবেন এক অন্যতম নির্ধারক শক্তি। কলকাতা ও দিল্লির বহু সাংবাদিক মমতার দিল্লি সফরের সময় ফোন করেছেন। প্রশ্ন একটাই, মমতা কার সঙ্গে বৈঠক করছেন? যেন, ব্যাপারটা এমন, দিল্লি এসেই আহমেদ পটেল বা রাজনাথ সিংহর সঙ্গে বৈঠক করে ফেলতেন মমতা, তার পরই ঘোষণা করে দেবেন তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যাবেন না কি বিজেপি-র সঙ্গে। না কি তিনি মুলায়ম বা মায়াবতীর সঙ্গে বৈঠক করে বলবেন, এত দ্বারা জানাইতেছি যে ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠন হল। কৌতূহলী সাংবাদিকদের বলছিলাম, আসলে রাষ্ট্রপুঞ্জে হাঁটতে হাঁটতে যদি মনমোহন সিংহের সঙ্গে নওয়াজ শরিফের করমর্দন হয় তা হলেই সেটা একটা বড় খবর। এটাকে বলা হয়, ফটো অপ। ফটো অপরচুনিটি। ওবামার সঙ্গে যদি ইরানের প্রেসিডেন্টের দেখা হয়, কথা প্রয়োজন নেই, নিছক পারস্পরিক কুশল বিনিময় হয়, তা হলে সেটাও তো এক বড় ঘটনা। আজকের রাজনীতিতে ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম ও ডিজিটাল যুগের অসীম প্রভাব। তাই বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বা ভিস্যুয়াল ফুটেজও রাজনীতির অঙ্গ।
দিল্লির রাজনীতিকেও তাই কালো বা সাদা এ ভাবে না দেখে বরং আবিষ্কার করা যাক তার ধূসরতাকে। এই ধূসরতাকে আবিষ্কার করছেন তৃণমূলনেত্রীও।
|
|
মমতা কী চান? |
আমার নিজের মনে হয়, না-কংগ্রেস, না-বিজেপি, তিনি চান একটি আঞ্চলিক দলের সরকার হোক, তবে কংগ্রেস বা বিজেপি-র সমর্থন ছাড়া সে সরকার গঠন যে আজও কার্যত অসম্ভব, সেটা তিনিও জানেন।
গোটা দেশে মমতার দলের শক্তি নেই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে কতটা বেশি আসন আনা যায় তার চেষ্টা তিনি করবেন। অন্য কয়েকটি রাজ্যেও তিনি কিছু আসনে প্রার্থী দিতে পারেন। তবে উত্তরপ্রদেশে আসনসংখ্যা ৮০। রাজ্যটা ভেঙেও এখনও লোকসভার আসনসংখ্যা ৮০। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ ৪২। তাই মমতার বক্তব্য, আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে কে প্রথম হবে সেটি ঠিক করা উচিত নিছক সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, বিচার করা উচিত অনুপাতের ভিত্তিতে।
২০১৪ সালে ভোটের ফলাফল কী হবে, তা অজানা। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলই এখন থেকে তাদের নিজেদের ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে। ভারতের রাজনীতিতে এখন কংগ্রেস যে দুর্বল, গোটা দেশে যে একটা কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া বইছে, এ ব্যাপারে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কংগ্রেস দুর্বল হলেই সেই রাজনৈতিক পরিসরটা যে গোটা দেশে বিজেপি একক ভাবে দখল করবে, সেই পরিস্থিতিটাও নেই।
১৯৬৭ সালে দেশের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রথম বেশ কয়েকটা রাজ্যে ধাক্কা খেয়েছিল। নেহরু-পরবর্তী কংগ্রেস রাজনীতিতে সেটাই ছিল প্রথম অশনি সঙ্কেত। কিন্তু তার পর একাত্তর সালে আবার কংগ্রেস পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বে নতুন কংগ্রেস তৈরি হয়েছে। সাতাত্তর সালে জরুরি অবস্থার পরিণতি হিসেবে আবার কংগ্রেস বিরোধী হাওয়ার সাক্ষী থেকেছেন ভারতের মানুষ। আবার ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হলেন। তখন কংগ্রেস বিরোধী হাওয়া আবার তীব্র ভাবে দেখা গেল।
কাজেই দশ বছর অন্তর কংগ্রেসের বিপর্যয় ভারতের ইতিহাসে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, এখন এটা শুধু দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভর করছে না। ১৯৮০ সালে বিজেপি জন্ম নিল। কিন্তু কংগ্রেস বা বিজেপি কেউই একক ভাবে দিল্লির মসনদ দখল করার জায়গায় থাকল না। তার ফলে এখন যে রাজনীতি হয়েছে সেটা হল ইউপিএ বনাম এনডিএ-র রাজনীতি। রাজনীতির বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকে বলা হচ্ছে, ‘বাইপোলার অ্যালায়েন্স সিস্টেম’। এখন এই ব্যবস্থায় আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোটা যে-কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দলের কাছে সোজা। তবে নবীন পট্টনায়েকই হোন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রত্যক্ষ ভাবে আবার এনডিএ-র শরিক হওয়া কঠিন।
ফলে মমতা এখনও পর্যন্ত বিজেপি-র সঙ্গে কিছুতেই প্রত্যক্ষ সমঝোতা করতে রাজি নন। আবার ইউপিএ-র অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কংগ্রেসের উপরেও বেজায় রুষ্ট। আর এই কারণেই আঞ্চলিক দলগুলির নেতাদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু এখনই কোনও ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করছেন না। তিনি জানেন, যদি সংখ্যা থাকে, আঞ্চলিক ফ্রন্ট গঠন করতে বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না। কাজেই যা হবে লোকসভা নির্বাচনের আগের থেকে পরে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু যা হওয়ার সব ২০১৪ সালের পরে হবে এটাই ধরে নিয়ে রাজনৈতিক জনসংযোগ না রাখাটাও যে কোনও কাজের কথা নয়, সেটাও মমতা বোঝেন। আর সেটাই তিনি এ বার দিল্লি সফরে করলেন। তিন দিন থেকে তিনি বহু নেতার সঙ্গে সংযোগ ঝালিয়ে গেলেন। সেখানে কংগ্রেসের আহমেদ পটেল যেমন আছেন, বিজেপির আডবাণী-রাজনাথ সিংহ যেমন আছেন, তেমনই জগন থেকে ডিএমকে-এডিএমকে-র আঞ্চলিক দলের নেতারাও আছেন।
একটি জিনিস খুব স্পষ্ট যে কেন্দ্রে ক্ষমতায় যে-ই আসুন না কেন, তৃণমূল কংগ্রেস হবে এক অন্যতম নির্ধারক শক্তি। এবং কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অনেক বেশি মধুর করতে এ বার তৎপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
পুরনো সমাচার: ইন্ডিয়া নয়, তাঁরা ভারতের প্রতিনিধি |
|
|
|
|
|