ইন্ডিয়া নয়, তাঁরা ভারতের প্রতিনিধি
রাজনৈতিক নেতারা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, বিশেষত যদি তাঁরা বেশ অনেক দিন ধরে শাসক দলের মর্যাদা উপভোগ করতে থাকেন তখন তাঁদের অনেকেরই একটা অসুখ হয়। অসুখটির নাম, রাজনৈতিক রাতকানা— পলিটিক্যাল ব্লাইন্ডনেস। মাত্য-অমাত্য তাঁদের শুধু ভাল ভাল সুখকর খবর পরিবেশন করেন, ফলে তাঁরা ‘ফিল গুড’ তথ্যে এত অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন যে প্রতিকূল পরিস্থিতির আঁচ পর্যন্ত পান না। সম্প্রতি সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী একটি বইতে দেখিয়েছেন, কী ভাবে আমাদের সমাজে ‘নার্সিসিজম’ এক ধরনের ‘ডেসপেয়ার’-এর জন্ম দিচ্ছে।
অটলবিহারী বাজপেয়ী তখন প্রধানমন্ত্রী। লালকৃষ্ণ আডবাণী দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী। নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগেই বিজেপি ভোট ঘোষণা করে দিয়েছে। বাজপেয়ী খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু আডবাণীর মনে হয়েছিল এনডিএ-র শাসন দেশের এত ভাল করেছে— মানুষ বিজেপি-কেই ভোট দেবে। একটি স্যুটিং-শার্টিং সংস্থার কাপড়ের বিজ্ঞাপনের বাক্য ধার করে বিজেপি-ও প্রচার শুরু করে ‘ফিল গুড’। মানুষ এনডিএ জমানায় সন্তুষ্ট, তৃপ্ত, খুশি। কারণ ভারত উদয় হচ্ছে। তখন আডবাণীকে এক দিন বলেছিলাম, আপনারা এ সব বলছেন, কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কৃষকদের আত্মহত্যার খবর আসছে। জবাবে সে দিনের উপপ্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ডোন্ট ওরি। উই উইল ম্যানেজ ইট।’ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনার পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বলেছিলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু উঠে আসছেন দ্রুত। সিপিএমের দুর্দিন আসন্ন এমনটাই সবাই বলছে। ওপিনিয়ন ফ্রম দ্য গ্রাউন্ড। বুদ্ধবাবু সে দিন আমাকে বলেছিলেন, ‘মানুষ বোকা নয়। মমতা কী ও কেন সেটাও মানুষ বোঝে।’
দলের প্রতীক ঝাড়ু হাতে জয়ের উল্লাসে মেতেছেন আপ-এর কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি: পিটিআই।
আজ রাহুল গাঁধী যতই রাজ্য সফর করুন আর দলীয় ওয়ার রুমে বসে রণকৌশল স্থির করুন না কেন, মানুষ যে তীব্র কংগ্রেস-বিরোধী হয়ে উঠেছে সেটা এ বার বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও টের পাননি সনিয়া-রাহুল, এমনকী, শীলা দীক্ষিতও। কেজরিওয়াল এক নতুন সামাজিক ফেনোমেনন। ভোটের কয়েক দিন আগেও জি-টিভির সম্পাদক যখন দিল্লির এই তিন টার্মের মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেন, তখনও তিনি বলেন, ‘কেজরিওয়ালের ব্যাপারে বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না।’ ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার বা ইয়েস মিনিস্টার সিরিয়ালটি দেখেছেন তো? আমাদের দেশেও শীলা দীক্ষিতকে একই ভাবে যে স্তাবকের দল ঘিরে রেখেছিলেন তাঁরাও বলেছেন, ‘চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আপনিই হলেন দলের সবচেয়ে বড় ‘ফেস’— সৎ, প্রোঅ্যাকটিভ অবয়ব।’ কিন্তু বাস্তবে যে তা নয় সেটা কিন্তু শীলাও বুঝতে পারেননি। কমনওয়েলেথের দুর্নীতি, দিল্লির ধর্ষণ, পেঁয়াজের দাম— সব মিলিয়ে মানুষ যে শীলা দীক্ষিতের উপর কতটা রেগে ছিল তা টের পাওয়া গেল কেজরিওয়ালের কাজে। পঁচিশ হাজার ভোটে শীলার পরাজয়ের ঘটনায়।
সামনে গভীর অনিশ্চয়তা।
ছবি: পিটিআই।
তবে গোটা দেশ জুড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত গঠন নতুন ঘটনা নয়। চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে প্রথম কংগ্রেস ধাক্কা খেয়েছিল। এর পর ইন্দিরা ’৭৭ দেখেছেন, রাজীব দেখেছেন ’৮৯। শুধু শীলা বা অশোক গহলৌতকে দোষ দিলে চলবে না। গোটা দেশ জুড়ে মনমোহন সিংহ সরকারের বিরুদ্ধে যে তীব্র জনমত, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, নীতিপঙ্গুতা— সেই সর্বভারতীয় ক্ষোভও কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে কাজ করেছে। কারণ, বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বিজেপি নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে আসরে নামিয়ে দিয়েছে। তাতে কংগ্রেস বিরোধিতার পরিসর বিজেপি-র পক্ষে দখল করতে সুবিধেই হয়েছে। কিন্তু এটাও বোঝা যাচ্ছে, যত দ্রুত কংগ্রেসের অবক্ষয় হচ্ছে, গোটা দেশে সেই দ্রুত গতিতে বিজেপি-র শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে না। ফলে দিল্লিতে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও কেজরিওয়ালের মতো এক ‘ভুঁইফোড়’ ৭০টির মধ্যে দিল্লিতে ২৮টি আসন দখল করে নিতে পারেন।
কংগ্রেস প্রাচীনতম দল। বিজেপি-র জন্ম ১৯৮০ সালে। তার আগে ছিল জনসঙ্ঘ। ৩৩ বছরের বিজেপি যখন প্রথম মাঠে নামে তখন আডবাণীর স্লোগান ছিল, বিজেপি পার্টি উইথ ডিফারেন্স। নতুন মূল্যবোধ। জমিদারি ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক কংগ্রেসের মানসিকতার বিরুদ্ধে বিজেপি-র নব্য জাতীয়তাবাদী চ্যালেঞ্জ ছিল এক নতুন প্রোডাক্ট। কারণ বিজেপি তখন ছিল বিরোধী দল। স্লোগান ছিল, আমাদের বাজপেয়ীর বিজেপিকে এক বার সুযোগ দিন। কিন্তু এ দেশের সিংহাসনে ছ’বছর ক্ষমতায় থেকেই বিজেপিও পরীক্ষিত। বিরোধী দলে থেকে গরিব মানুষের জন্য কান্নাকাটি করা, উন্নয়নের আওয়াজ তোলা, দারিদ্র দূরীকরণ ও চাকরি দেওয়ার স্বপ্ন বিক্রি, এ সবই খুব সহজ কাজ। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে এই রাজনৈতিক পপুলিজম ও প্রশাসনিকতার (গভর্ন্যান্স) মিলন ঘটানো যে এত কঠিন তা বিজেপি নেতারাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
ছবি: এএফপি।
এ বার এই শীতের নতুন অতিথি অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কত প্যাডিতে কত রাইস, সেটা কিন্তু তিনি এখনও টের পাননি। সে সুযোগ এখনও আসেনি তাঁর জীবনে। বরং বিরোধী নেতা হয়ে এ যাত্রা বেঁচেছেন। স্বপ্নের নতুন সওদাগর হিসাবে তাঁর পণ্য বিক্রির জন্য তিনি আরও কিছুটা সময় পেয়েছেন। ব্রিদিং স্পেস। ফরাসি বিপ্লব হত না যদি ভলতেয়ার-রুশো না থাকতেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত তাঁরাই প্রথম আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক সমাজ যাঁরা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আমজনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ দেশের নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটিও দীর্ঘ দিন ধরে এক এলিটতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক-সাংস্কৃতিক ও সামরিক অভিজাততন্ত্রের বৃত্তেরই বাসিন্দা। লেখক-সাহিত্যিক, এমনকী মিডিয়াও। কিন্তু কেজরিওয়ালের তৃতীয় শক্তি এক নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে, ইন্ডিয়া নয় তাঁরা ভারতের প্রতিনিধি। শুধু অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ নয়, কোচবিহারের, ছত্তীসগঢ়ের প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুলশিক্ষকও সেই নাগরিক সমাজের সদস্য।
আর তাই নবীন কেজরিওয়াল আসলে এক নতুন সেলসম্যান। তিনি বলেছেন, আমার এই তেলটা মাখুন, অনেক তেল তো মাখলেন, ফল পাননি। এটা মাখুন। চুল গজাবে। লোকাল ট্রেনের এই নতুন ফেরিওয়ালার বাণীতে আপনি মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু কেজরিওয়াল কি পারবেন এই ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিতে? এটা ঠিক, অণ্ণা হজারের আন্দোলনের পটভূমিতেই কেজরিওয়ালের লিখন। টি এন সেশনও নতুন দল করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু কেজরিওয়াল আপাত সাফল্য পেলেন। কিন্তু তা কত দিন? তিনি কী ভাবে এ দেশের বেকারি, দুর্নীতি ও ভ্রষ্ট রাজনীতি বদলাবেন? কেজরিওয়াল অনেকটা ‘ইনকিলাব’ ছবির অমিতাভ বচ্চনের মতোই। যেমন, জেমস বন্ড পর্দায় এলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতাশ দুঃখী ব্রিটিশ সমাজের ‘ইগো’ সন্তুষ্ট হয়েছিল, ঠিক সে ভাবে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও কেজরিওয়াল আসলে এক ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’।
কংগ্রেস বিরোধী এই পরিসর তা হলে ২০১৪ সালে কে নেবে? নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি-র পক্ষেও এই পরিসর দখল করা সহজ কাজ নয়। কারণ পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিজেপি কই? ফলে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলও ২০১৪ সালে নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠবে বিলক্ষণ! কেজরিওয়াল ফ্যাক্টর এখনও পর্যন্ত দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ। সর্বভারতীয় স্তরে আম আদমি পার্টি কই? তবে কী হবে ২০১৪-য়? তা নিয়ে না হয় পরের সপ্তাহে আড্ডা মারা যাবে!

পুরনো সমাচার:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.