জিরেন কাঠের টাটকা খেজুর রস কাঠের আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরী নলেন গুড়। তাকে খাঁটি দুধের সঙ্গে মিশিয়ে অল্প আঁচে তৈরি করা হয় ক্ষীর। তার সঙ্গে গাজর, কাজু, কিসমিস, মনাক্কা, পেস্তা, বাদাম সহ নানা উপকরণ মিশিয়ে ‘বেক’ করে তৈরি করা হয় বড়দিনের স্পেশ্যাল কেক। ২৫ ডিসেম্বর সকালে বা সন্ধ্যায় সেই কেক ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় মন্দিরের বিগ্রহকে। স্বাদে গন্ধে তো বটেই দেখনদারিতেও যে কোনও নামী কোম্পানির কেকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে এই কেক।
খ্রিস্ট উৎসবে নদিয়ার মঠ-মন্দিরে দেবতাদের ভোগে ক্রমশঃ জায়গা করে নিচ্ছে কেক। মায়াপুরে ইস্কন মন্দির বা নবদ্বীপ কোলেরডাঙ্গায় সারস্বত গৌড়ীয় মঠ বা কেশবজী গৌড়ীয় মঠের মতো বিদেশি ভক্তপ্রধান মন্দিরে তো বটেই নবদ্বীপের প্রাচীন মঠ-মন্দিরগুলোতেও বড়দিনের সময়ে বিশেষ ধরনের কেকের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠছে। মিষ্টির কারিগরদের দাবি, এইসব ছানা বা ক্ষীরের তৈরি অনেক কেক কেবল মাত্র নবদ্বীপেই পাওয়া যায় এবং তা স্থানীয় কারিগরদের নিজস্ব উদ্ভাবন।
নবদ্বীপ প্রাচীন মায়াপুরের জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস বাবাজী বলেন, “নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরে এই প্রথা খুব বেশি দিনের নয়। আমরা এখানে দেবতাকে আত্মবৎ সেবা করি। যার অর্থ ভক্ত যেমন ভাবে নিজে জীবনযাপন করে সেভাবেই দেবতার নিত্যসেবা করা হয়। তাই ভক্ত যদি বড়দিনে কেক খায়, তাঁর আরাধ্য দেবতাকেও তা নিবেদন করে খাবে। এই ভাবনা থেকেই নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরের ভোগে কেকের প্রচলন। আমাদের আশ্রমে বড়দিন উপলক্ষে দেবতার ভোগের জন্য দু-তিন রকমের কেক তৈরি করা হয়। সাদা ময়দা, সুজি, কাজু-কিসমিস নানা রকমের ফল দিয়ে ফ্রুটকেক নিজেরা তৈরি করি। ভক্তরা দোকান থেকে কিনে আনেন ছানা বা বিভিন্ন মিষ্টির কেক।”
গানতলার বলদেব মন্দিরের কিশোর গোস্বামী বলেন, “আমাদের মন্দিরেও বিগ্রহকে কেক ভোগ দেওয়া হয়। তবে তা ছানার তৈরি কেক। শুধু বড়দিনই নয়, ঝুলন পূর্ণিমায় বলদেবের জন্মতিথিতেও কেক দেওয়া হয়। সে কেক আবার বাঘনাপাড়া থেকে ভক্তরা বিশেষ ভাবে তৈরি করিয়ে আনেন। বাঘনাপাড়ায় এক ধরনের সুস্বাদু ছানার কেক পাওয়া যায়।”
ব্যতিক্রমী মিষ্টি তৈরিতে সুপরিচিত বাণী ঘোষ বলেন, “আমি ছানা বা ক্ষীর দিয়ে কত ধরনের কেক তৈরি করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছি। কেননা নবদ্বীপ মঠ-মন্দিরের শহর। আর সেই শহরে ছানা বা ক্ষীরের কেকের চাহিদা ক্রমশঃ বাড়ছে। পাল্টে যাওয়া সময়ের নতুন প্রজন্মের ভক্তদের চাহিদাও বদলে গেছে। বড়দিনে তাঁরা দেবতাকে কেক খাওয়াতে চাইবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আমরাও সেই জন্য তৈরি থাকছি।” মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরে সারা বছরই ভোগে কেক দেওয়া হয়। ইস্কনের জন সংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “মায়াপুরে ইস্কনের নিজস্ব বেকারিতে ভক্তরাই সেসব কেক তৈরি করেন। নানা রকমের ফ্রুটকেক আমাদের বিদেশী ভক্তরা তৈরি করেন। কেক তৈরিতে ওঁরা অনেকেই খুব দক্ষ। বেনানা কেক, মিক্সড ফ্রুটকেক, স্ট্রবেরি কেক, নানা রকমের চকোলেট কেক বড়দিনের সময় বেশি করে তৈরি করা হয়। দর্শনার্থীরা এই কেক প্রসাদ হিসেবে খুব পছন্দ করেন।
বড়দিনে নলেনগুড়ের হাত ধরে মিশে গেল প্রাচ্য, পাশ্চাত্য। |