কয়েক হাত দূরেই পদ্মা। ওপারে বাংলাদেশ। পদ্মার গা ঘেঁষে বয়ে চলা সীমান্তের লালগোলা-জঙ্গিপুর রাজ্যসড়কে তখনও কুয়াশা বেশ গাঢ়। মঙ্গলবারের সকাল দশটাতেও কুয়াশার আস্তরণ ঢেকে রয়েছে মাঠ-ঘাট-সড়ক। কুয়াশার সেই চাদর ফুঁড়ে ছুটে চলা যানবাহনগুলোকে দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন রহস্যযান। ওই সড়কপথের একটি তেমাথার নাম সেখালিপুর মোড়। একটু পরেই বোঝা গেল মোড়ের কাছে কনকনে শীতে এতক্ষণ ঘাপটি দিয়ে বসেছিলেন কয়েকজন। হঠাৎ সামনে থেকে ধেয়ে আসা রুপোলি রঙের একটি মোটরবাইকের সামনে এসে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়ালেন তাঁরা। বাইকের আরোহী দুই তরুণ। দু’জনের গায়েই জ্যাকেট। গলায় মাফলার। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের পরে জানা গেল, তাদের এক জন পদার্থবিদ্যায় অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কামরুজ্জামান ওরফে জামাল শেখ। অন্য জন মানজারুল ইসলাম এ বার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। এলাকার পরিচিত দুই ছাত্রকে পুলিশের হাতে পাকড়াও হতে দেখে তেমাথা মোড়ের চায়ের দোকানের বিস্ময় কাটেনি অনেকক্ষণ।
বিস্ময়ের তখনও আরও কিছু বাকি ছিল। দুই ছাত্রের দেহ তল্লাশি শুরু করলেন লালগোলা থানার ওসি রবি মালাকার। তাদরে জ্যাকেটের পকেট থেকে পাওয়া গেল দু’টি প্যাকেট। পলিথিনে মোড়া। পদ্মাপাড়ের সীমান্তের ছেলেবুড়ো সবাই ওই প্যাকেটগুলো ভালই চেনেন। তাঁদের ভাষায় ‘পাউডার’। ওজন ৫৫০ গ্রাম। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “ওই প্যাকেটে হেরোইন ছিল। তার এক কেজির দাম এক কোটি। এ দিন বাজেয়াপ্ত করা হোরোইনের বাজার মূল্য ৫৫ লক্ষ টাকা।” পুলিশ সুপার বলেন, “হেরোইন পাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট লালগোলা। আগে কেরিয়ার ছিলেন গরিব ঘরের মহিলারা। বেশ কয়েক জন মহিলাকে বমাল ধরে ফেলায় হেরোইন পাচারচক্র ছক পাল্টেছে। কেরিয়ার হিসাবে তারা স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করছে।”
সদ্য তরুণ জামাল বিহারের ভাগলপুরের দীপনারায়ণ সিংহ কলেজের পড়ুয়া। মানজারুল কয়েক বছর আগে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিল। এ বার স্থানীয় আই সি আর হাইমাদ্রাসার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। দু’জনেরই বাড়ি সীমন্ত থানা লালগোলার নশিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার রামচন্দ্রপুরে। দু’জনে মামাতো ভাই। পুলিশ জানায়, বছর দেড়েক থেকে ‘কেরিয়ার’ হিসাবে কাজ করছেন বলে জেরায় দু’জনেই স্বীকার করেছেন। জামাল বলেন, “দূরত্ব ও বিপদের ঝুঁকি অনুযায়ী মজুরি মেলে। কখনও ২ হাজার টাকা। কখনও ৫ হাজার টাকা।” জামালের দাদুর রেশন দোকান রয়েছে। সেই দোকান চালান জামালের বাবা ফতেউর রহমানরা তিন ভাই। সচ্ছল সংসার। তবুও কেন হেরোইন পাচারের কাজে নামলেন? জামলের জবাব, “লেখাপড়ার খরচ জোটাতে।”
তাঁর পরিবার, পুলিশ ও গ্রামের লোক সবাই সে কথা মানতে নারাজ। ফতেউরের দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বছর দু’য়েক আগে। ছেলে ছোটবেলা থেকে থাকে গ্রামের অন্য প্রান্তে মামার বাড়িতে। ফতেউর বলেন, “ছেলের কোনও আব্দার কোনও দিন অর্পূণ রাখিনি। মাঝে মধ্যেই লেখাপড়ার খরচ বলে আমাদের কাছ থেকে ৫-৭ হাজার টাকা করে নিয়েছে। কিন্তু ছেলে হেরোইন পাচার করবে, ভাবতেও পারিনি।” জামালের জেঠু খলিলুর রহমান স্থানীয় নশীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধানের স্বামী। তিনি বলেন, “মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে জামাল সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিকেও শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই ছেলে কী করে হেরোইন পাচার করে!”
মেধাবী ছাত্রের উচ্ছন্নে যাওয়ার শুরু বছর দেড়েক আগে। খলিলুরদের তিন ভাই-এর যৌথ জমি ভাড়া দেওয়া রয়েছে মোবাইলের টাওয়ারের জন্য। ভাড়ার টাকার জন্য তিন ভাইয়ের নামে যৌথ একটি ব্যাঙ্ক আকাউন্ট আছে। খলিলুর বলেন, “ওই অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়তি করে ৪০ হাজার টাকা তুলে নিয়ে জামাল একটি মোটর বাইক কেনে বছর দেড়েক হল।” সেই বাইকে করেই এ দিন হেরোইন পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে সে।” রামচন্দ্রপুর গ্রামের কয়েক জনের কথায়, বছর খানেক থেকে জামাল বদলে গিয়েছিল। দামি মোবাইল, দামি পোশাক, যথেচ্ছ খরচের হাত। তার তুলনায় মানজারুলের ৬ জনের পরিবারের ৪ জনই দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি ও বিড়িশ্রমিক। মানজারুলের দাবি, “অভাবের কারণে পাচারের কাজে ঢুকেছিলাম।” |